পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর ভ্যাকসিন হতে পারে ‘সাঁতার’

পানিতে ডুবে মৃত্যুরোধের ভ্যাকসিন ‘সাঁতার’

পানিতে ডুবে মৃত্যুরোধের ভ্যাকসিন ‘সাঁতার’ তাই সনাতন পদ্ধতিতে সাতার শেখানো হচ্ছে
সর্বমোট পঠিত : 137 বার
জুম ইন জুম আউট পরে পড়ুন প্রিন্ট

বেসরকারি সংস্থা ‘সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ, বাংলাদেশ’(সিআইপআরবি) দীর্ঘদিন ধরে পানিতে ডুবে মৃত্যুর বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন ধরনের জরিপ ও গবেষণার কাজ করছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং ইউনিসেফ-বাংলাদেশের সহযোগিতায় সিআইপিআরবি ২০০৫ সালে বাংলাদেশ হেলথ অ্যান্ড ইনজুরি সার্ভে এবং তার ধারাবাহিকতায় ২০১৬ সালে অনুরূপ একটি জরিপ পরিচালনা করে। শেরপুর সহ দেশের ৭টি উপজেলায় পরিচালিত এ জরিপের মাধ্যমে পানিতে ডুবে মৃত্যুর যে চিত্র পাওয়া যায়, তাতে দেখা যায়, ২০১৬ সালের তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী, প্রতিবছর সব বয়সি প্রায় ১৯ হাজার মানুষ পানিতে ডুবে মৃত্যুবরণ করে। এদের তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি ১৮ বছরের কম বয়সি শিশু। এ জরিপটিতে অধিক সংখ্যক উন্মুক্ত জলাশয়, সচেতনতার অভাব, ছোট শিশুদের ক্ষেত্রে অপর্যাপ্ত তত্ত্বাবধানে, শিশুদের সাঁতার না জানা এবং কমিউনিটিতে প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদানবিষয়ক কোনো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা না থাকা বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে শিশুদের পানিতে ডুবে যাওয়ার প্রধান প্রধান কারণ হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে।

পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর ভ্যাকসিন হতে পারে ‘সাঁতার’। ৫-১০ বছর বয়সী শিশুদের সাঁতার শেখানো গেলে পানিতে ডুবে মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যেতে পারে হাজারো শিশুর প্রাণ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পানিতে ডুবে মৃত্যুর হার কমিয়ে আনার অন্যতম প্রধান পথই হচ্ছে সাঁতার শেখানো। পানিতে ডুবে মৃত্যুর হার এতই বেশি যে জাতিসংঘ একে 'নীরব মহামারি' বলে আখ্যা দিয়েছে।
সাঁতার না জানার কারণে বাংলাদেশে প্রতিমাসে গড়ে ৮২ জন প্রাণ হারাচ্ছে বলে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের বরাত দিয়ে জানিয়েছে গণমাধ্যম ও উন্নয়ন যোগাযোগ সংগঠন সমষ্টি। সংস্থাটির সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ২৩ জুলাই পর্যন্ত ১৯ মাসে ৯৬৭টি ঘটনায় সারাদেশে ১ হাজার ৫৬২ জন পানিতে ডুবে মারা গেছে। এরমধ্যে ৭০ শতাংশের বয়স ১০ বছরের কম। সমষ্টি পরিচালক মীর মাসরুর জামান জানান, দেশে জাতীয়ভাবে পানিতে ডুবে মৃত্যু নিয়ে কোনো তথ্য ব্যবস্থাপনা না থাকায় এর প্রকৃত চিত্র পাওয়া যায় না। সাধারণত পানিতে ডুবে মৃত্যুর সবগুলো ঘটনা গণমাধ্যমে উঠে আসে না। ইউনিসেফের ২০১৬ সালের একটি পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে দৈনিক ৪৮ জন এবং বছরে ১৮ হাজারের বেশি ছেলেমেয়ে পানিতে ডুবে মারা যায়। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, এক থেকে ১৭ বছরের শিশুদের মধ্যে অন্য যে কোনো রোগে আক্রান্তে মৃত্যুর চেয়ে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। যা মোট শিশুমৃত্যুর প্রায় ২৮ শতাংশ।

বেসরকারি সংস্থা ‘সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ, বাংলাদেশ’(সিআইপআরবি) দীর্ঘদিন ধরে পানিতে ডুবে মৃত্যুর বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন ধরনের জরিপ ও গবেষণার কাজ করছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং ইউনিসেফ-বাংলাদেশের সহযোগিতায় সিআইপিআরবি ২০০৫ সালে বাংলাদেশ হেলথ অ্যান্ড ইনজুরি সার্ভে এবং তার ধারাবাহিকতায় ২০১৬ সালে অনুরূপ একটি জরিপ পরিচালনা করে। শেরপুর সহ দেশের ৭টি উপজেলায় পরিচালিত এ জরিপের মাধ্যমে পানিতে ডুবে মৃত্যুর যে চিত্র পাওয়া যায়, তাতে দেখা যায়, ২০১৬ সালের তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী, প্রতিবছর সব বয়সি প্রায় ১৯ হাজার মানুষ পানিতে ডুবে মৃত্যুবরণ করে। এদের তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি ১৮ বছরের কম বয়সি শিশু। এ জরিপটিতে অধিক সংখ্যক উন্মুক্ত জলাশয়, সচেতনতার অভাব, ছোট শিশুদের ক্ষেত্রে অপর্যাপ্ত তত্ত্বাবধানে, শিশুদের সাঁতার না জানা এবং কমিউনিটিতে প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদানবিষয়ক কোনো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা না থাকা বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে শিশুদের পানিতে ডুবে যাওয়ার প্রধান প্রধান কারণ হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে।

সিআইপিআরবি’র গবেষনা বলছে, পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু প্রতিরোধে দেশের অবকাঠামোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ পদক্ষেপগুলোর মধ্যো সম্প্রতি উদ্ভাবিত স্বল্পব্যয়ে বাস্তবায়নযোগ্য দুটি প্রধান ব্যবস্থা চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রথমটি হচ্ছে, পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুদের জন্য ‘আঁচল’নামক কমিউনিটি ডে-কেয়ার এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে ৬-১০ বছর বয়সি শিশুদের জন্য ‘সুইমসেইফ’নামক জীবন রক্ষাকারী সাঁতার প্রশিক্ষণ কর্মসূচি। সুইমসেইফ কর্মসূচির মাধ্যমে ৬-১০ বছর বয়সি শিশুরা স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষিত একজন কমিউনিটি সাঁতার প্রশিক্ষকের সহায়তায় জীবন রক্ষাকারী সাঁতার দক্ষতার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। স্থানীয় পুকুরে বাঁশ দিয়ে তৈরি একটি নিরাপদ বেষ্টনীর ভেতর শিশুদের সাঁতার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। শিশুরা প্রতিদিন আধ ঘণ্টা এ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে এবং গড়ে ১৪ দিনের মধ্যে তারা ২৫ মিটার সাঁতার কাটার এবং ৩০ সেকেন্ড গভীর পানিতে ভেসে থাকার দক্ষতা অর্জন করে। যা জীবন রক্ষাকারী সাঁতারের মানদন্ড বলে উল্লেখ করা হয়। কমিউনিটি পর্যায়ে সাঁতার শেখানোর জন্য শিশুপ্রতি ব্যয় এক হাজার টাকারও কম।

শেরপুর জেলা ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা ডা. খায়রুল কবীর সুমন বলেন, বিভিন্ন রোগ ছাড়াও বাংলাদেশে প্রতিবছর বড় সংখ্যক শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ৫ বছরের নিচে শিশুমৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ২৫ নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। আমরা শিশুমৃত্যুর হার কমিয়ে আনার জন্য জন্মের পর থেকে ৫ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের ৬টি মারাত্মক সংক্রামক রোগের ভ্যাকসিন (টিকা) দিচ্ছি। কিন্তু শিশুরা সবগুলো ভ্যাকসিন পেয়েও কেবল সাঁতার না জানার ৫ বছর বয়স অতিক্রম করার পর  প্রতিবছর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিশু পানিতে ডুবে মারা যাচ্ছে। সেজন্য শিশু সুরক্ষায় জীবনের জন্য সাঁতার হতে পারে ভ্যাকসিনের মতো এক কার্যকর মহৌষধ।

সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ, বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি) উপ-নির্বাহী পরিচালক ড. আমিনুর রহমান বলেন, পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু প্রতিরোধযোগ্য। গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব শিশু আঁচল কার্যক্রমে দিনে নির্ধারিত চার ঘণ্টা অবস্থান করে, তাদের পানিতে ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা ৮০ শতাংশেরও অধিক কমে যায়। একইভাবে, সুইমসেইফ কর্মসূচি ৯০ শতাংশের বেশি সুরক্ষা প্রদান করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক প্রকাশিত ‘গ্লোবাল রিপোর্ট অন ড্রাউনিং-প্রিভেনটিং অ্যা লিডিং কিলার’(২০১৪)-এ পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু প্রতিরোধকল্পে যে তিনটি উদ্ভাবনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তার মধ্যে সাঁতার অন্যতম। ২০১৫ সালের মার্চে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে একটি পরিপত্র প্রকাশ করা হয়। যেখানে পানিতে ডুবে মৃত্যু থেকে শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে দেশের সব উচ্চ মাধ্যমিক, মাধ্যমিক ও নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়, সমমানের মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাঁতার প্রশিক্ষণ ও অনুশীলন বাধ্যতামূলক করার কথা বলা হয়েছে।

তিনি জানান, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জনসচেতনতা বৃদ্ধিকল্পে কিছু উদ্যোগ নিয়েছে এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক গৃহীত পাঁচ বছরের নিচে দুই লাখ শিশুর সুষ্ঠু তত্ত্বাবধান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আট হাজার কমিউনিটি ডে-কেয়ার সেন্টার স্থাপন এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাধ্যমে ৬-১০ বছর বয়সি শিশুদের সাঁতার শেখানোর একটি প্রকল্প প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। তবে শিশুদের এ অনাকাঙ্খিত মৃত্যু প্রতিরোধে যত দ্রুত সম্ভব এসব কার্যক্রম দেশব্যাপী পরিচালনা করার এখনই সময়।
গত ২৫ জুলাই জাতিসংঘের ঘোষণা অনুযায়ী, আন্তর্জাতিকভাবে প্রথমবারের মতো বিশ্ব পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধ দিবস পালিত হয়েছে। পানিতে ডুবে যাওয়া প্রতিরোধকল্পে ‘যে কেউ পানিতে ডুবে যেতে পারে, সবাই মিলে প্রতিরোধ করি’ প্রতিপাদ্য নিয়ে দিবসটি পালিত হয়। দিবসটি পালনের জন্য জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ও স্থায়ী প্রতিনিধি রাবাব ফাতিমা যে প্রস্তাবনা সাধারণ পরিষদে উল্লেখ করেছিলেন তাতে বলা হয়েছে, ‘গবেষণা দ্বারা প্রমাণিত, স্বল্পব্যয়ের প্রতিরোধ ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রতিটি পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধ করা সম্ভব। পানিতে ডুবে যাওয়া প্রতিরোধে গৃহীত পদক্ষেপ টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট লক্ষ্যমাত্রার বেশ কয়েকটির অর্জনকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য তাৎপর্যপূর্ণ সুযোগ সৃষ্টি করেছে।’

গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে. চৌধুরী বলেন, জাতিসংঘের প্রস্তাব পাসের পর পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুরোধে বাংলাদেশের দায়িত্বও অনেক বেড়ে গেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ বিষয়ে মনিটরিং জোরদার করা দরকার। শুধু প্রজ্ঞাপন জারি করলে হবে না, তা কার্যকর করতে হবে।

গ্লোবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটরের কান্ট্রি লিডার রুহুল কুদ্দুস বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সাঁতার শেখার উদ্যোগ কার্যকর করা দরকার। বিশেষ করে বর্ষাকালে সচেতনতামূলক প্রচার চালালে অনেক শিশুকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানো সম্ভব। তাছাড়া কমিউনিটি পর্যায়ে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেও শিশুদের সাঁতার শেখানোর পদক্ষেপ পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু রোধে কার্যকর ভুমিকা রাখতে পারে।

মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরা এমপি জানান, পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু প্রতিরোধে দিবাযতœ কেন্দ্র ও সাঁতার শেখায় সরকার ও দাতা সংস্থার যৌথ উদ্যোগে পাইলট ভিত্তিতে কয়েকটি জেলায় কিছু কিছু কাজ হচ্ছে। শিশু সুরক্ষার জন্য দেশব্যাপী এসব কার্যক্রম সম্প্রসারণের লক্ষ্যে এ বিষয়ে ডিপিপি (ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রপোজাল) প্রণয়ন করা হয়েছে। ডিপিপিটি যাতে দ্রুত একনেকে অনুমোদন হয়, সে প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

মন্তব্য

আরও দেখুন

নতুন যুগ টিভি