বর্তমান সময়ের মফস্বল সাংবাদিকতা ও আমার দুটি কথা

বর্তমান সময়ের মফস্বল সাংবাদিকতা ও আমার দুটি কথা
সর্বমোট পঠিত : 150 বার
জুম ইন জুম আউট পরে পড়ুন প্রিন্ট

আমাদের দাবী একটাই বাংলাদেশের মফস্বল সাংবাদিকদের জন্য করা হউক নিয়োগ বিধি, বেতন কাঠামোসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধার নীতিমালা। মফস্বল সাংবাদিকদের ওয়েজবোর্ড অনুযায়ী বেতন ভাতার ব্যবস্থা করা হউক,  মফস্বল সাংবাদিকতায় ফিরে আসুক শৃঙ্খলা।


॥ মো: মেরাজ উদ্দিন ॥
রাজধানী ঢাকার বাইরে যারা বিভাগ, জেলা, উপজেলা ও পৌর এলাকায় অবস্থান করে বিভিন্ন প্রিন্ট, ইলেক্ট্রনিক ও অনলাইন মিডিয়ায় সংবাদ সংগ্রহ এবং প্রেরণ করে থাকেন তাদেরকেই মফস্বল সাংবাদিক বলা হয়ে থাকে। 
আর ঢাকার বাইরে থেকে প্রকাশিত সংবাদ পত্র হচ্ছে মফস্বল পত্রিকা। মফস্বলের পত্রিকাগুলোকে আঞ্চলিক পত্রিকাও বলা হয়ে থাকে। 
আমরা যদি বাংলাদেশের সংবাদ পত্রের ইতিহাস জানতে যাই, তাহলে দেখাযায় বাংলাদেশ ভূখন্ডে প্রথম প্রকাশিত পত্রিকা মফস্বল থেকেই প্রথম প্রকাশিত হয়েছিলো। 
ভারত উপমহাদেশে প্রথম সংবাদপত্র প্রকাশ করেছিলো মূলত ইংরেজরা। এ উপমহাদেশে প্রথম ১৭৮০ সালে কলকাতায় 'বেঙ্গল গেজেট" নামে একটি দুই পাতার ইংরেজী সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করেছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়ার একজন কর্মচারী, যার নাম জেমস আগাষ্ট হিকি। উপমহাদেশে প্রথম বাংলা পত্রিকা/সাময়িকী প্রকাশ করা হয় ১৮১৮ সালে। যার উদ্যোক্তা ছিলেন, পশ্চিম বঙ্গের হাওরা অঞ্চলের শ্রীরামপুরের বেপ্টিষ্ট মিশনারীরা। মিশনের পক্ষে পাদ্রী ক্লার্ক মার্সম্যান এর সম্পাদনায় 'দিগদর্শন' নামের প্রথম বাংলা পত্রিকা প্রকাশিত হয়। আর বাংলাদেশ ভূখন্ডে ১৮৪৭ সালে 'রঙ্গপুর বার্তাবহ' নামে প্রথম সংবাদ পত্র প্রকাশিত হয় বর্তমান রংপুর জেলা থেকে। কুন্ডিপরগনার জমিদার কালিচন্দ্র রায় চৌধুরীর অর্থায়নে গুরুচরণ রায় এ সাপ্তাহিক পত্রিকাটির সম্পাদনা করেন। 
বাংলাদেশের সংবাদপত্রের যাত্রা মফস্বল এলাকা থেকে শুরু হলেও আজ মফস্বল এলাকার পত্রিকা ও সাংবাদিকরাই অবহেলিত। 
নানা কারণে বাংলাদেশের মফস্বল সাংবাদিকদের এখন দূর্দিন চলছে। অবশ্য মফস্বল সাংবাদিকদের কেউ রিপোর্টার, কেউ সংবাদদাতা আবার অনেকেই সাংঘাতিক বলেও অবিহীত করে থাকেন। অনেকেই মফস্বল সাংবাদিকদের সাংবাদিক হিসেবেই মানতে নারাজ। অথচ তারা জানেন না একজন মফস্বল সাংবাদিক ঢাকায় অবস্থানরত সাংবাদিকদের চেয়েও অনেক বেশী দায়িত্ব পালন করে থাকেন।
বর্তমানে রাজধানীর বাইরে মফস্বলের সাংবাদিকতা পর্যাপ্ত বিস্তৃত হয়েছে এবং বিভিন্ন সমস্যা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের মফস্বল সাংবাদিকতা বিপুল সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করেছে। মফস্বল শব্দটির আভিধানিক অর্থ ”শহর বহির্ভূত স্থান” বা ”গ্রাম”। এই অর্থে মফস্বলের খবর মানে গ্রামের খবর। কিন্তু বাস্তবে ঢাকার বাইরে শহর গ্রামগঞ্জ জনপদের খবরই মফস্বলের খবর। সুতরাং মফস্বল সাংবাদিকতা বলতে রাজধানী ঢাকার বাইরে বিভিন্ন মাত্রার সাংবাদিকদের বুঝানো হয়।
আমি এ প্রসঙ্গে একটি বাস্তব চিত্র তুলে ধরতে চাই, আমি ও আমার আরেক সহকর্মী সময় টিভির শহিদুল ইসলাম হীরা, বিগত বছর চারেক আগে রাত এগারোটার সময় জানতে পারি ভারতীয় এক নাগরিককে সিলেট সীমান্ত দিয়ে অপহরণ করে বাংলাদেশে এনে মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ দাবী করা হয়েছে। ওই নাগরিককে শেরপুরের ঝিনাইগাতী থানা পুলিশ উদ্ধার করেছে। তাকে ঝিনাইগাতী থানায় রাখা হয়েছে। সেদিন বৃষ্টি হচ্ছিলো ও আকাশে বিজলী চমকাচ্ছিলো। আমাদের টেলিভিশন অফিসকে জানানো হলে নিউজটি পাঠানোর জন্য বলা হলো। আমরা দুইজনই বৃষ্টি উপেক্ষা করে মোটর সাইকেলে রাত একটার সময় ঝিনাইগাতী থানায় হাজির হই। তৎকালীন পুলিশ সুপার আমাদের দেখ বলে উঠলেন আপনারা এ পরিস্থিতিতে কীভাবে আসলেন। সেখানে ভিডিও ফুটেজ, ভক্সপপ/সট ও তথ্য সংগ্রহ করে রাত তিনটার দিকে বৃষ্টি ও হালকা ঝড়ের মধ্যেই শেরপুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করি। আর নিউজ পাঠানোর পর সকাল হয়ে যায়। এরকম প্রতিনিয়তই দিনরাত ২৪ ঘন্টায় আমাদের সংবাদ সংগ্রহ এবং প্রেরণ করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়। এটা মফস্বল সাংবাদিকের রুটিন ওয়ার্কের মধ্যেই পড়ে। আর যারা প্রিন্ট মিডিয়ায় কাজ করেন, তাদেরকে সংবাদ সংগ্রহ থেকে শুরু করে বিজ্ঞাপন সংগ্রহ, বিল উত্তোলন সব কিছুই এক ব্যক্তিকেই করতে হয়। বর্তমানে ডিজিটাল যুগে আমরা অবস্থান করছি। এ যুগে যখনই কোন ঘঠনা ঘটছে, তখনই সবার আগে তা প্রযুক্তির মাধ্যমে পাঠাতে হবে । যাতে দ্রুত পাঠকদের সামনে তুলে ধরতে পারে সচিত্র তথ্য ও প্রতিবেদন, সে কাজটার আমরা মফস্বলের সাংবাদিকরা সদা প্রস্তুত থাকি। 
অথচ ১৯৮৭ সাল থেকে মফস্বলে সাংবাদিকতা শুরু করেছি। তখন নিউজ পাঠাতে ফ্যাক্স, ইন্টারনেট ছিল না। পত্রিকা অফিসে শুধু টেলিপ্রিন্টার দেখেছি। এতে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার নিউজগুলো আসত। আমি খামভর্তি করে খোলাডাকে নিউজ ও সাদাকালো ছবি ডাকযোগে পত্রিকা অফিসে পাঠাতাম।
ঢাকার বাইরে থেকে পত্রিকা অফিসে তাৎক্ষণিক জরুরি নিউজ পাঠানোর কাজটি ছিল অত্যন্ত কঠিন। বন্যা, প্রাকৃতিক দূর্যোগ, সড়ক দুর্ঘটনা, অগ্নিকাণ্ড, খুন-রাহাজানির মতো জরুরি খবরগুলো সাধারণত টেলিফোনে পাঠাতাম। ফোনের জন্য শেরপুর টেলিফোন একচেঞ্জে গিয়ে কত ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেছি তার ইয়ত্তা নেই। ফোনে চিৎকার করে পত্রিকা অফিসে নিউজ পাঠিয়েছি সংক্ষেপে। ‘হ্যালো ঢাকা - হ্যালো ঢাকা’ বলে চিৎকার করতে করতে কণ্ঠনালী ব্যথা হয়ে যেত। কখনো কখনো ঢাকায় ফোন লাইন পাইনি। টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ ছিল না।
দুই দিন থেকে দশদিন পরও পত্রিকা খুললে আমার পাঠানো নিউজ ছাপার অক্ষরে পড়তে পেতাম। আমার নিউজ প্রকাশিত পত্রিকায় দেখে খুব আনন্দ পেতাম। ওই আনন্দ আসলে এখন আর পাইনা। আর ওই সময় কপিপেষ্ট সাংবাদিকতা ছিলোনা। বর্তমানে একজন একটি খবর লিখলে ও খবরের সিসি দিয়েই অধিকাংশজনের চলে যায়। কিন্তু ওই সময় তা ছিলোনা। আর ঘরে-ঘরে সাংবাদিকও ছিলোনা। বর্তমানে ইমেইল, এফিটিপ, হুয়াটসএপ, ম্যাসেঞ্জারসহ নানা উপায়ে মুহুর্তেই খবর, ছবি  ফুটেজ পৌছানো সম্ভব হয়ে উঠে।     
আর যারা ডেস্কে কাজ করেন, তারা এক ব্যক্তি কিন্ত সব কাজ করেননা। আলাদা আলাদা দায়িত্ব দেয়া থাকে তাদের। তারা নির্দিষ্ট দায়িত্বটাই পালন করে থাকেন।
আবার সব করতে গিয়ে ভূল হলেও কিন্তু কোন ক্ষমা নেই মফস্বলের অবহেলিত সাংবাদিকের। সেদিকটাও খেয়াল রাখতেই হবে। কেননা যখন কোন মানুষের সফলতা বা ভালো কাজের একটি খবর প্রকাশিত বা প্রচারিত হয় তখন একটি ধন্যবাদও সাংবাদকিরা পাননা। কিন্তু কেউ যদি কোন অনিয়ম বা সমাজ, রাষ্ট্র বিরোধী, অপরাধমূলক কাজ বা দূর্নীতি করেন, এ খবর প্রকাশিত/প্রচারিত হলে সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকের আর নিস্তার নেই। তার চৌদ্দগোষ্ঠীকে তুলে বাজে কথা, হুমকি-ধমকি, হামলা-মামলা ইত্যাদির পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়। 
ঢাকার বাইরে থেকে পাঠানো সংবাদগুলো গুরুত্ব অনুযায়ী সংবাদ পত্রের বিভিন্ন পাতায় প্রকাশিত হয়। এছাড়া মফস্বলের সংবাদ প্রকাশের জন্য স্বতন্ত্র পাতা আছে প্রতিটি সংবাদপত্রে।  প্রথম আলো সারা দেশ, বিশাল বাংলা, দৈনিক জনকন্ঠের দেশের খবর, জনপদের খবর, দৈনিক সমকালে লোকালয়, দৈনিক ইনকিলাবের অভ্যন্তরিন এর পাশাপাশি বিভিন্ন দৈনিক সংবাদ পত্রের অঞ্চল, মহানগর, বিভাগ ও জেলা কেন্দ্রিক স্বতন্ত্র পাতাও প্রকাশ করে থাকে। আবার বেসরকারী টেলিভিশন ও অনলাইন নিউজ পোর্টালে মফস্বলের নিউজগুলো গুরুত্বসহকারে প্রচার করে থাকে। 
বর্তমানে আমরা যেটা লক্ষ করছি ঢাকা কেন্দ্রিক খবরের চেয়ে মফস্বল এলাকার খবরের গুরুত্ব কোন অংশেই কম নয়। বরং বর্তমানে মফস্বল এলাকার সংবাদ গুলোই অধিক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আর যারা যেসব মফস্বল সাংবাদিকরা এ কাজে নিয়োজিত তাদের গুরুত্বও কিন্তু কম নয়। মফস্বলেও অনেক যোগ্যতাসম্পন্ন সাংবাদিক রয়েছেন। যারা তাদের প্রাপ্য সম্মান, সম্মানী কোনটাই পাচ্ছেননা। 
কোন দৈনিক, জাতীয় দৈনিক, সাপ্তাহিক পত্রিকার সংবাদদাতা হিসেবে যারা কাজ করে থাকেন, তাদের সকলের পরিচয় সাংবাদিক। 
একজন সফল সাংবাদিক যে শিক্ষা দিক্ষা, অভিজ্ঞতা, দক্ষতা, যোগ্যতা, পর্যবেক্ষণক্ষমতা, মেধা ও প্রতিভা থাকা দরকার তা একজন মফস্বল সাংবাদিকেরও আছে। সুযোগ সুবিধা দেওয়ার ব্যপারটি তার পারফরমেন্সের ওপর হওয়া উচিৎ। সংবাদপত্র কর্তৃপক্ষ এটা কোনো সময় ভেবে দেখেন না। মফস্বলের দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকার সাংবাদিকদের অবস্থা আরও করুন। 
বর্তমানে দেশে মিডিয়ার অভাব নেই। হাতে গোনা কয়েকটি টিলিভিশন, পত্রিকা ও অনলাইন নাম মাত্র সম্মানী দিলেও আর সবাই ফ্রীতে কাজ করিয়ে নিচ্ছে তাদের দেয়া কার্ডধারী সাংবাদিকদের কাছ থেকে। বেতন তো দেনইনা উল্টো কার্ডের খরচ বাবদ টাকাও নেন অনেকেই, এমন অভিযোগও আমরা পেয়ে থাকি। যে কারণে কার্ড দেয়ার সময় ভাল-মন্দ, শিক্ষা কোনটারই দেখার প্রয়োজন মনে করেননা তারা। আর ওই কার্ড গলায় ঝুলিয়েই তারা নেমে পড়ছে মাঠে। এটাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছি অনেকেই। কিন্তু কিভাবে সম্ভব ? প্রশ্নটা আমার এখানেই।
বেতন ভাতা, সুযোগ সুবিধাবিহীন নিয়োগকৃত সাংবাদিক পরিচয়পত্র বহনকারী ওই সব সাংবাদিকরা পরিচয়পত্র ভাঙ্গিয়ে খেতে তারা অভ্যস্ত হয়ে ওঠছে। ওই সব সাংবাদিকরা বাধ্য হয়ে হলুদ সাংবাদিকতার পথ বেছে নেয়। জাতির বিবেক সাংবাদিকতা হয়ে যায় বিতর্কিত কলঙ্কিত, মহান পেশা সাংবাদিক থেকে হয়ে যায় সাংঘাতিক।   
যে কারণে নানা জায়গায় মফস্বল সাংবাদিকরা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছেন। অবৈতনিক মফস্বল সাংবাদিকদের মর্যাদা আসলে আগের জায়গায় নেই। তাই এখন সব জায়গায় দাবী উঠেছে অবহেলিত মফস্বল সাংবাদিকদের প্রাপ্য অধিকার দেয়া হউক। বলা হয়ে থাকে সাংবাদিকদের ওয়েজবোর্ড বাস্তাবায়নের কথা। তথ্যমন্ত্রনালয়ের তালিকায় অনেক পত্রিকার পার্শ্বই লেখা থাকে ওয়েজবোর্ড বাস্তাবায়ন করা আছে। আমি যতটুকু জানি, ওয়েজবোর্ড জেলা/উপজেলা প্রতিনিধির জন্যও। কিন্তু মফস্বল সাংবাদিকরা তাদের অধিকার কখনও পায়না। তাছাড়া প্রতিনিধি নিয়োগের নেই কোন নীতিমালাও। অবহেলিত মফস্বল সাংবাদিকদের কথা আসলে কেউ ভাবেন বলে আমাদের জানা নেই। যে কারণে যারতার হাতে চলে যাচ্ছে মহান পেশা সেই সাংবাদিকতার সার্টিফেকট বা পরিচয় পত্র। 
আর এ জন্য অনেকেই সাংবাদিকতার মহান জায়গাটাকে কলুষিত করতে দ্বিধা করছেননা। এতে প্রকৃত সাংবাদিকরা হচ্ছেন বিব্রত। 
এখন আমাদের দাবী একটাই বাংলাদেশের মফস্বল সাংবাদিকদের জন্য করা হউক নিয়োগ বিধি, বেতন কাঠামোসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধার নীতিমালা। 
সবশেষে মফস্বল সাংবাদিকদের ওয়েজবোর্ড অনুযায়ী বেতন ভাতার ব্যবস্থা করা হউক,  মফস্বল সাংবাদিকতায় ফিরে আসুক শৃঙ্খলা।

 (লেখক একজন শিক্ষাবিদ ও গনমাধ্যম কর্মী)


মন্তব্য

আরও দেখুন

নতুন যুগ টিভি