ইব্রাহিম মনোয়ার লেখা ফিচার

টিকার কার্যকারিতা নিয়ে বিশ্ব রাজনীতি

টিকা
সর্বমোট পঠিত : 148 বার
জুম ইন জুম আউট পরে পড়ুন প্রিন্ট

যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদনের মধ্য দিয়ে সিনোফার্ম তার গ্রহণযোগ্যতা ফিরে পেয়েছে। তাই সাধারণ মানুষের মাঝে এই ভ্যাকসিন নিয়ে যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে তা চায়নার কর্তৃপক্ষকে আরও বিভিন্ন গবেষণা পত্রে ভ্যাকসিন এর কার্যকারিতা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের উদ্বেগ দূর করার দায়িত্ব নিতে হবে। না হলে আগামী দিনে সিনোফার্মের ভ্যাকসিন নিয়ে সাধারণ মানুষের যেকোন ধরণের ক্ষতিতে সরকারের ভ্যাকসিন কর্মসূচি মারাত্মক ভাবে ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।


প্রাণঘাতি ভাইরাস কোভিড-১৯ মোকাবেলায় সারাবিশ্বে একযোগে চলছে গণটিকা কর্মসূচী। উন্নত দেশগুলো ইতিমধ্যে তাদের সাধারণ জনগণের ২ ডোজ টিকা সম্পন্ন করে এখন চালাচ্ছে বুস্টার ডোজ টিকা প্রদান কার্যক্রম। কিন্তু বিশ্বে অনেক দেশ আছে যারা এখনো কাঙ্খিত টিকাই পাচ্ছেনা কিন্তু প্রথম থেকেই বাংলাদেশ সরকারের সফল যোগাযোগ ও দূরদর্শী চিন্তাভাবনায় উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে এই বাংলাদেশেও প্রতিদিন চলছে দৃশ্যমান গণটিকা কার্যক্রম।

আবার টিকা নিয়ে উৎপাদনকারী দেশগুলোর মাঝে শুরু হয়েছে আত্মসম্মান ও নিজেদের দক্ষতা প্রমাণের এক অদৃশ্য লড়াই। নিজেদের উৎপাদিত টিকা বিশ্বের সর্বাধিক দেশের গ্রহণযোগ্যতা প্রাপ্তির লক্ষ্যে চলছে বিশ্বরাজনীতি যাতে লাভ ক্ষতি দুটোই রয়েছে মর্মে জানান অনেকে। আবার এসব টিকার মাঝেও রয়েছে ভিন্নতা বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে বেশী সমাদৃত হয়েছে অক্সফোর্ডের এ্যাস্ট্রেজেনেকা, ফাইজার, আমেরিকার মর্ডাণা কিন্তু এর পাশাপাশি চলছে চিনের সিনোফার্মা ভেরোসেল, রাশিয়ার স্পুটনিক-৫ ইত্যাদি। বিভিন্ন দেশ আবার চাইনার এই সিনোফার্মা টিকা গ্রহণকারীদের তাদের দেশে প্রবেশে দিয়েছে নানা শর্ত বা পরোক্ষ পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা যাদের মধ্যে সৌদি অন্যতম যারা ওমরাহ যাত্রীদের জন্য শুধু ৪টি টিকা যথাক্রমে এ্যাস্ট্রেজেনেকা, ফাইজার, মর্ডাণা ও জনসন এন্ড জনসন টিকা গ্রহণকারীদেরই তাদের দেশে প্রবেশের অনুমতি দিয়েছে এইবার যা নিয়ে গভীর চিন্তায় পরে গেছে চায়নার সিনোফার্ম টিকাসহ অন্যান্য বিভিন্ন দেশের টিকা গ্রহণকারীদের অনেকে। এদিকে বাংলাদেশে প্রথম থেকে এ্যাস্ট্র্যাজেনেকার টিকা প্রদান কার্যক্রম পরবর্তী বর্তমানে জেলা শহরগুলোতে চলছে সিনোফার্মের গণটিকা কার্যক্রম।

উপোরোক্ত বিষয়ের সাথে কিছুটা সম্পর্কিত অন্য একটি প্রসঙ্গে কথা বললে বলতে হয়, বাংলাদেশে গত এক দশকেরও বেশি রাজনীতিতে আলোচিত ও সমালোচিত ব্যক্তিত্ব হলেন আল্লামা বাবুনগরী যিনি গত কয়েকদিন আগে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর হেফাজতের প্রতিষ্ঠাতা আমির শাহ আহমেদ শফির মৃত্যুর পর কওমি মাদ্রাসা কেন্দ্রীক সংগঠনটির নেতৃত্বে আসেন বাবুনগরী, গত বছরের ১৫ নভেম্বর সম্মেলন করে তাকে আমির ঘোষণা করেন হেফাজত ইসলাম। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল শফির মৃত্যুতে হত্যার অভিযোগে যে মামলাটি হয়েছিল সেই অভিযোগের প্রমাণ পাওয়ার কথা জানায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত সংস্থা পিবিআই।

বাবুনগরী হেফাজতের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই একটা অদৃশ্যমান অস্থিরতার মধ্যে যাচ্ছিল হেফাজত ইসলাম। অবশেষে ১৮ আগস্ট বাবুনগরীর মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে একটা অধ্যায়ের অবসান হল। এদিকে হেফাজতের আমির বাবুনগরী মারা যাওয়ার আগে বেশ কিছুদিন যাবত বিভিন্ন বার্ধক্য জনিত রোগে ভুগছিলেন। বিশেষ করে তিনি ডায়াবেটিক,  কিডনি, উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগ সহ বিভিন্ন ধরনের সমস্যায় ভুগছিলেন। তিনি চলতি মাসের ৮ আগষ্ট চট্টগ্রামের হাট-হাজারির স্বাস্থ্য কমপেক্সে গিয়ে চায়নার সিনোফার্মের ভ্যাকসিন/টিকা  গ্রহণ করেন। ১৮ আগস্ট বাবুনগরীর মৃত্যুর পর ইতিমধ্যেই সারা দেশজুড়ে তার অনুসারীদের মধ্যে সমালোচনার ঝড়সহ নানা আতঙ্ক ছড়িয়েছে যে সিনোফার্মের ভ্যাকসিন নেওয়ার পর তাঁর শারীরিক অবস্থা অবনতির দিকে চলে যায় এবং ভ্যাকসিন নেওয়ার ১২ দিনের মাথায় তার মৃত্যু হয়।

যদিও বাবুনগরী এক সময়ে করোনার ভ্যাকসিন নেওয়ার ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করেছিলেন এবং এটি (ভ্যাকসিন) ইসলাম সম্মত নয় বলে তার মতামত প্রকাশ করেন, কিন্তু যেই দিন উনি ভ্যাকসিন গ্রহণ করলেন সেই দিন ভ্যাকসিন সম্পর্কে তিনি বলেন ভ্যাকসিনকে হারাম বা নাজায়েজ বলা যাবে না শরিয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে। চিকিৎসা বিজ্ঞান শরিয়তের জায়েজ এবং চিকিৎসা বিধি মেনে চলতে হবে সবাইকে, তাই তিনি ভ্যাকসিন গ্রহণ করেছে। ইনশাল্লাহ কোন সমস্যা হয়নি তার বলে মন্তব্য করেছিলেন। এখানে মূল বিষয় হচ্ছে বাবু নগরীর ভ্যাকসিন গ্রহণ করার পর তাঁর মৃত্যু নিয়ে উনার অনুসারীদের মধ্যে ভ্যাকসিন নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে সেটি বৈজ্ঞানিক ভাবে সিনোফার্ম বা চায়নার অস্পষ্ট বক্তব্যের কারণেই। কারণ করোনা ভাইরাসের কোন ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে চীনের কোন ভ্যাকসিন বা টিকা কোনটা কার্যকর কিংবা এইসব ভ্যাকসিন এর কোন গুরুতর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া রয়েছে কিনা চীন তার গবেষণায় এখন পর্যন্ত স্পষ্ট করেনি। এদিকে আশ্চর্যজনক বক্তব্য দিয়েছেন চীনের সংক্রামকব্যাধি বিশেষজ্ঞ জং নাং সাংকে। তিনি বলেছেন যেই গবেষণার ভিত্তিতে চীন তাদের ভ্যাকসিন এর কার্যকারতা কথা বলেছেন তা এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছেন।

শুধু তাই নয় চায়নিজ সেন্টার ফর ডিজিস্ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশনের সাবেক উপ-পরিচালক ফেং জিয়াং সম্প্রতি চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত সেন্ট্রাল টেলিভিশনে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন চীনের তৈরি দুইটা ভ্যাকসিন করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট  বিরুদ্ধে কম কার্যকর। তবে তিনি কৌশলে ভ্যাকসিন দুইটির নাম উল্লেখ করেন নি । অথচ মডার্না ও ফাইজারসহ বিভিন্ন দেশ তাদের ভ্যাকসিন এর বিস্তারিত প্রতি মুহুর্তে তুলে ধরেন। যার ফলে চীনের ভ্যাকসিন থেকে অন্যান্য ভ্যাকসিন এর প্রতি গণ মানুষের আস্থা বেড়েছে। ফাইজার মডার্নার ভ্যাকসিন যেই প্রযুক্তিতে তৈরি হয়েছে তা এমআরএনএ নামে পরিচিত। এতে মানুষের দেহে একটি মেসেন্জার সিকুয়েন্স প্রবেশ করানো হয় যাতে জেনেটিক নির্দেশ থাকে। এ নির্দেশে ঐ ব্যক্তির দেহে অ্যান্টিজেন উৎপাদনের কথা বলা হয় এবং প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়। এমআরএনএ আধুনিক বিশ্বে সবচেয়ে প্রযুক্তি সম্পন্ন বলা হয় যা একে বারেই নতুন। ফলে যে বিষয়টি পরিষ্কার হচ্ছে পৃথিবীর প্রতিটা ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী রাষ্ট্র তাদের উৎপাদিত ভ্যাকসিন নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা প্রকাশ করলেও চীন বরাবরই তা থেকে বিরত থেকেছে। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই সাধারণ মানুষের মাঝে চায়নার তৈরি সিনোফার্মের ভ্যাকসিন নিয়ে একধরনের ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে যা বাবু নগরীর মৃত্যুর মধ্য দিয়েই এই সন্দেহ আরও পাকাপোক্ত হয়েছে বলে অনেকেই এখন মনে করছেন যদিও অনেকেই আবার এটিকে উড়িয়ে দিয়েছেন নিছক গুজব হিসেবে।

যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদনের মধ্য দিয়ে সিনোফার্ম তার গ্রহণযোগ্যতা ফিরে পেয়েছে। তাই সাধারণ মানুষের মাঝে এই ভ্যাকসিন নিয়ে যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে তা চায়নার কর্তৃপক্ষকে আরও বিভিন্ন গবেষণা পত্রে ভ্যাকসিন এর কার্যকারিতা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের উদ্বেগ দূর করার দায়িত্ব নিতে হবে। না হলে আগামী দিনে সিনোফার্মের ভ্যাকসিন নিয়ে সাধারণ মানুষের যেকোন ধরণের ক্ষতিতে সরকারের ভ্যাকসিন কর্মসূচি মারাত্মক ভাবে ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

লেখক : ইব্রাহিম মনোয়ার, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

মন্তব্য

আরও দেখুন

নতুন যুগ টিভি