তসলিমা নাসরিন

তসলিমা নাসরিন-এর ইঞ্জিনিয়ারের বাড়ি

তসলিমা নাসরিন
সর্বমোট পঠিত : 226 বার
জুম ইন জুম আউট পরে পড়ুন প্রিন্ট

রাজেশ গুলাটি মুখে বালিশ চেপে অনুপমার শ্বাস রোধ করেছে। এরপর অনুপমার শরীরটা যখন শান্ত হয়ে পড়ে রইলো বিছানায়, রাজেশ বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। লম্বা শ্বাস নিল। শ্বাসের সঙ্গে ঢুকে গেল সহস্রধারার বনে ফুটে থাকা জুঁই ফুলের ঘ্রাণ। এই ঘ্রাণের কথা অনেকদিন আগে অনুপমা বলেছিল। রাজেশকে বারান্দায় এনে চোখ বন্ধ করে লম্বা শ্বাস নিতে বলেছিল। সারা বছরই, অনুপমা বলতো, কোনও না কোনও ফুলের ঘ্রাণ ভেসে আসে। জুঁই ছিল অনুপমার খুব পছন্দের ফুল। সিগারেট এমনিতে রাজেশ খায় না, কিন্তু আজ একটিতে আগুন ধরালো। গোটা একটি প্যাকেট সে দু’দিন আগে কিনেছে। খুব টেনশনের সময় সিগারেট খেলে তার খানিকটা আরাম হয় বলে। কিন্তু যতটা টেনশন তার হবে বলে মনে হয়েছিল, ততটা, সে অনুভব করে, হচ্ছে না। দু’ তিনবার ফুঁকে টবের মাটিতে গুঁজে সিগারেটের আগুন নিভিয়ে দেয়। অনুপমা মৃত, এবং রাজেশ জীবিত–এই দৃশ্যটির জন্য সে কমপক্ষে তিন মাস অপেক্ষা করেছে। শেষ পর্যন্ত দিনটি এসেছে। অনুপমাহীন পৃথিবীর রূপরসগন্ধ উপভোগ করার সময় এখন রাজেশের।

অনুপমাকে সে ডিভোর্স দিতে পারতো, এক সময় সে তা-ই চেয়েছিল। কিন্তু ওর মতো মেয়ে ডিভোর্স পেয়েও দিব্যি আবার হেসে-খেলেই বেড়াবে, রাজেশের চেয়ে ভালো কাউকে, হয়তো ত্রিদিবকেই, বিয়ে করে দিব্যি সুখের সংসার করবে, হয়তো ব্যবসায়ী বাবার সঙ্গে ব্যবসায় নেমে বিরাট ধন দৌলতও করে ফেলবে, বলা যায় না, রাজেশের চেয়েও বেশি সফল হয়ে যেতে পারে, রাজেশের অনুপস্থিতি হয়তো সে অনুভব করবেই না, হয়তো ভুলেই যাবে রাজেশ বলে কারও সঙ্গে অনেকগুলো বছর সে কাটিয়েছে। না, তার পক্ষে সম্ভব নয় দিনের পর দিন অনুপমার ওই দম্ভ দেখা, রাজেশকে টপকে যাওয়া দেখা। ডিভোর্স দিলেও এই পৃথিবীতেই অনুপমা বেঁচে থাকবে, আর রাজেশের কাছেই খবর আসতে থাকবে অনুপমার, খবর আসতে থাকবে কেমন চমৎকার জীবন সে যাপন করছে! তাছাড়া ডিভোর্স দিলে বদনাম হবে রাজেশেরই। অফিসের লোকেরা বলবে, অনুপমা ভাবী তো বেজায় ভালো ছিলেন, এমন অমায়িক, এমন আন্তরিক লাখে একটিও নেই, তাকেই কিনা ডিভোর্স দিলেন মিস্টার রাজেশ গুলাটি! দ্বিতীয় কোনও মেয়ে তার সঙ্গে সম্পর্কে রাজি হবে না, ভয় পাবে, ভাববে হয়তো তাকেও এভাবে একদিন ডিভোর্স দেবে রাজেশ। যে স্বাতীর সঙ্গে গোপনে সে প্রেমালাপ করে, সেও হয়তো বেঁকে বসবে। না, স্বাতী তাকে একবারও বলেনি অনুপমাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে। এ তারই ভাবনা, তারই পরিকল্পনা। তার একার। এ এমন এক কাজ যে কাজ কাউকে বলে-ক’য়ে করা যায় না, দলবল নিয়েও করা যায় না। একা করলেই ঠান্ডা মাথায় করা যায়। ঠান্ডা মাথায় সে অনুপমার মুখের ওপর বালিশ চেপে ধরেছে। চেপে ধরার ইচ্ছেটা তার ছিলই, ইচ্ছেটাকে শতগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে অনুপমা। কী দরকার ছিল তার ওসব বলার! কথোপকথন অনুপমাই ওভাবে গড়াতে দিচ্ছিল।
–স্বাতীর সঙ্গে তো তুমি প্রেম করতে চাইছো।
–কী করে জানলে?
–তোমার ইমেইল তুমি লগআউট করতে সবসময় ভুলে যাও। আর আমি পড়ে ফেলতে পারি তোমার সব কীর্তিকলাপ।
–গোপনে অন্যের ইমেইল পড়তে লজ্জা করে না?
–না, করে না। তুমিও আমার ইমেইল পড়। আমার ফোনের মেসেজ পড়ো। তোমার কাছ থেকেই অনুমতি না নিয়ে পড়া শিখেছি।
–প্রাইভেসি বলে কিছু আছে বলে বিশ্বাস করো না নাকি?
–তোমার বেলায় প্রাইভেসি। আর আমার বেলায় বলো স্বামী স্ত্রীর মধ্যে গোপন কিছু থাকতে নেই।
–ইকুয়ালিটি চাও?
–নিশ্চয়ই চাই।
–তাহলে সংসারের খরচ আমি যত দিই, তত তুমিও দাও।
–টাকা পয়সার লোভটা তোমার আর গেল না।
–কথা এড়াচ্ছো কেন?
–তুমি তাহলে সংসারের হাল ধরো, সন্তান লালন পালন করো। আমি বাইরে গিয়ে চাকরি করি। অথবা ঘর সংসার বাচ্চা কাচ্চা সারভেন্টদের হাতে দিয়ে দাও। দু’জন চলো চাকরি করি। তার আগে আমাকে মাস্টার্সটা কমপ্লিট করতে হবে, যেটা তোমার কারণে সম্ভব হয়নি।
–যে চাকরিই করো, আমার সমান রোজগার তো তোমার হবে না।
–হবে না বলে বুঝি তুমি প্রভুত্ব করবে? কিন্তু আমি তো দাসি হতে পারবো না। সংসারটা পার্টনারশিপের ব্যবসা নয় যে যত ইনভেস্ট করবে সে তত প্রফিট পাবে। সংসারে আমাদের ইকুয়ালিটির পেছনে থাকতে হবে পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস আর ভালোবাসা।
–সেটা তো তোমার নেই।
–আমার আছে, সে কারণেই স্বাতীর সঙ্গে তোমার প্রেম করতে চাওয়া আমাকে কষ্ট দেয়।
–ত্রিদিবের সঙ্গে তোমার কী ছিল শুনি? সেটা আমার জন্য ডিস্টার্বিং ছিল না?
–ত্রিদিব তোমার নিউ জার্সির অফিসের জুনিয়ার কলিগ। তোমার সঙ্গে কথা বলতে সে আমাদের নিউ জার্সির বাড়িতে আসতো। খুব স্বাভাবিক যে আমার সঙ্গেও তার কথা হতো।
–শুধু কথাই হতো, আর কিছু হয়নি? তুমি তো শুয়েছো ত্রিদিবের সঙ্গে!
–আমি লক্ষ্য করেছি, যখনই আমি স্বাতী সম্পর্কে জানতে চাই, তুমি ত্রিদিবকে জড়িয়ে আমাকে বিস্তর বাজে কথা বলো। তুমি পুরোনো প্রসঙ্গ তুলছো, যেন তোমার নতুন প্রসঙ্গ, স্বাতী প্রসঙ্গ, চাপা পড়ে যায়।
–কথা এড়িয়ে যাচ্ছ, আমি জানতে চাইছি ত্রিদিবের সঙ্গে শুয়েছো কিনা।
–এই প্রশ্নটি কত বার তুমি আমাকে করেছো, এবং কতবার আমি তার জবাব দিয়েছি, তার কি তোমার কাছে হিসেব আছে কোনও?
–আমি যা জিজ্ঞেস করছি, তার উত্তর দাও।
—-অনেকবার বলেছি, আবারও বলেছি, তুমি যে মানসিক অত্যাচার করতে আমাকে, বলতে আমার বাবা তোমাকে পণ দেয়নি, তোমাকে ঠকিয়েছে। আমাকে চাপ দিতে আমি যেন বাবাকে টাকা পাঠাতে বলি। হ্যাঁ, সেসব আমি ত্রিদিবকে বলেছি, কারণ ত্রিদিবকে আমি বন্ধু ভাবতাম।
–বন্ধু? তুমি ওকে প্রেমিক ভাবতে। ওর সঙ্গে পালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল তোমার।
–পালিয়ে যেতে হবে কেন। যেতে হলে বলে-কয়েই যাবো। কিন্তু ত্রিদিবের সঙ্গে, তুমিও ভালো করে জানো, আমার সম্পর্ক প্রেমের ছিল না। তবে এটা ঠিক, একসময় সে আমার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছিল। আমিই তোমাকে বলেছি সব। আমাকে সে বিয়ে করতে চেয়েছিল, আমি তাকে বুঝিয়ে বলেছি যে এ সম্ভব নয়।
–কেন সম্ভব নয়? আমাকে ছেড়ে তুমি চলে যেতেই পারতে। ত্রিদিব দেখতে ভালো, ভালো চাকরি, অবিবাহিত, আমেরিকায় সেটেল্ড, কোম্পানির ওয়ান অব দ্য ডিরেক্টরস। আর কী চাই?
–হ্যাঁ যেতে পারতাম। ত্রিদিব ভদ্র ছেলে, ব্রিলিয়ান্ট, সিনসিয়ার। মানুষ হিসেবে তোমার চেয়ে ফার বেটার। ত্রিদিবের জন্য নয়, তোমার অত্যাচারের কারণেই তোমাকে ত্যাগ করা আমার দরকার ছিল। কিন্তু পারিনি সোনাক্ষী আর সিদ্ধার্থের জন্য।
–সোনাক্ষী আর সিদ্ধার্থ না থাকলে কী করতে? যেতে না?
অনুপমা চুপ করে থাকে। ধাক্কা দিয়ে অনুপমার শরীরে, রাজেশ বলে, কী করতে বললে না যে?
–তোমাকে ডিভোর্স দিতাম।
–আমাকে ডিভোর্স দিতে! কত বড় সাহস!
–তোমাকে ডিভোর্স দিতে সাহসের দরকার হয় না। আত্মসম্মান থাকলেই দেওয়া যায়।

অনুপমার মুখে আত্মসম্মান শব্দটি শুনলে রাজেশের মাথা বনবন করে ঘোরে, শব্দটি থেকে একটি স্ফুলিঙ্গ রাজেশের শরীরে ছুটে এসে আগুন ধরিয়ে দেয়। অনুপমা উঠে গিয়েছিল। ওকে ফের চুলের মুঠি ধরে টেনে নিয়ে আসে শোবার ঘরে। সোনাক্ষী আর সিদ্ধার্থ– যমজ ভাইবোনদুটো– ঘুমিয়ে গেছে। মধ্যরাতের নৈঃশব্দর ওপর ঝিঁঝিঁ পোকারা আলতো করে শুয়ে আছে, আর দেরাদুন জুড়ে সবুজ ঘাসের মতো ছড়িয়ে আছে বুনো জুঁইয়ের সুগন্ধ। শোবার ঘরের দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করে বারান্দায় যাওয়ার দরজাটা খোলে রাজেশ। এবার অনুপমাকে হিঁচড়ে বারান্দায় নিয়ে রেলিংএর ওপর শরীরটাকে ঠেসে ধরে। পা দুটো উঁচু করতে চায়। অনুপমা চিৎকার করে ওঠে। দু’পায়ের শক্তি দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সে, দু’হাতে রেলিং আঁকড়ে থাকে। অনুপমা বোঝে যে রাজেশ তাকে নিচে ফেলে দিতে চাইছে, যেন মরে যায়, যেন সকালে উঠে ওর থেতলে যাওয়া শরীর দেখে লোকে বলে, মেয়েটা অসুখী ছিল, আত্মহত্যা করেছে। অনুপমার চিৎকারের জন্য রাজেশ তাকে ফেলে দিতে পারেনি নিচে। অগত্যা শোবার ঘরে নিয়ে ধাক্কা দিয়ে বিছানায় ফেলে বালিশ চেপে ধরে মুখের ওপর। অনেকক্ষণ অনপমা মুখ থেকে বালিশটি সরানোর চেষ্টা করে, পারে না। অনুপমার হাত দুটো রাজেশ তার দু হাঁটু দিয়ে চেপে রেখেছিল। ননীটা ছানাটা খেয়ে বড় হওয়া রাজেশের গায়ের শক্তি অনুপমাকে হারিয়ে দেয়। লাশটাকে সে-রাতেই রাজেশ পুরোনো জিনিসপত্র রাখার ঘরে রেখে দেয়। ঘরটি তালাবন্ধ থাকে।

সকালে মা’কে খোঁজে বাচ্চারা। রাজেশ ওদের বলে দেয়, মা নানাবাড়ি গেছে। কবে ফিরবে, বলে যায়নি। অনুপমার অনুপস্থিতি বাড়ির কাউকে রাজেশ টের পেতে দেয় না। রান্না করা আর ঘর দোর ধোয়া মোছার জন্য যে মেয়েরা আসে, তাদের সাত দিনের ছুটি দিতে চেয়েছিল রাজেশ, কিন্তু ব্যাপারটা আবার কারো চোখে রহস্যময় মনে হয় কিনা, সে কারণে রাজেশ ওদের আর ছুটি দেয় না, তবে কাজ যত কম করানো যায় করিয়ে বিদেয় করে। নিজে সে অফিস থেকে ছুটি নিয়ে ঘরেই থাকে। অনুপমা দিল্লিতে, সুতরাং বাচ্চাদের দেখভাল করার জন্য ছুটি তার দরকার, এ অফিসের লোকেরা বোঝে। কিন্তু রাজেশ তার ছুটি বাচ্চাদের দেখভাল করে কাটায় না, কাটায় নিজের শোবার ঘর আর বারান্দায় পায়চারি ক’রে। মাঝে মাঝে তালাবন্ধ দরজার কাছে গিয়ে গিয়ে শুঁকে দেখে কোনও দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে কিনা। ছ’তলা থেকে অনুপমাকে ফেলে দিলে এই ঝামেলা পোহাতে হতো না। মরে যাওয়ার পরও ফেলা যেত, কিন্তু তখন রাজেশের মনে হয়েছে প্রতিবেশিরা হয়তো বুঝে যাবে কাজটি কে করেছে। কারণ আত্মহত্যা করার মতো দুঃখ বা হতাশা অনুপমার ছিল না।

বাচ্চারা ঘুমিয়ে গেলে তালাবন্ধ ঘরটির তালা খুলে ভেতরে ঢোকে রাজেশ। ঢুকে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দেয়। বড় একটি ছুরি শান দিয়ে এনেছে রান্নাঘর থেকে । দুপুরে বাজারে গিয়ে একটি ইলেক্ট্রিক করাত কিনেছে আর দশটি কিনেছে প্লাস্টিকের ব্যাগ। এবার অনুপমার শরীরকে সে টুকরো টুকরো করে কাটে। গানের আওয়াজ বাড়িয়ে দেয় যেন করাতের আওয়াজ গানের আওয়াজের তলায় পড়ে হারিয়ে যায়। বাচ্চারা এই গান শুনে অভ্যস্ত, অনুপমা আর রাজেশের তুমুল ঝগড়া হলে এভাবেই গান চালিয়ে ঝগড়ার আওয়াজটা রাজেশ কম করতো। বাচ্চাদের কানের চেয়ে পড়শির কানের কথা সে বেশি ভাবতো।

একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে এক অনার্স পাস মেয়ের বিয়ে হয়েছে, অথচ আশ্চর্য, রাজেশ ভাবে, এ বিয়েয় তাকে পণ দেওয়া হয়নি! রাজেশ চায়নি পণ, তা ঠিক। কিন্তু অনুপমার বাবার তো দায়িত্ব ছিল পণ দেওয়া। এমন তো নয় যে তার টাকার কিছু অভাব ছিল! আমেরিকায় যাওয়ার পর তার একটি গাড়ির দরকার ছিল, একটি বাড়িও কেনার দরকার ছিল। এমন হীরের টুকরো ছেলের সঙ্গে মেয়ে বিয়ে দিয়ে অন্য যে কোনও বাবাই বাড়ি গাড়ি কেনার টাকা পাঠাতো, অনুপমার বাবা বলেই পাঠায়নি। রাজেশ এই বাবাকে ক্ষমা করতে পারে না। আরও খুঁটিয়ে দেখলে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারের বউ হওয়ার জন্য অনুপমার যতটা সুন্দরী হওয়ার দরকার ছিল, ততটা সে নয়। তারপরও অনুপমাকে বিয়ে করতে সে রাজি হয়েছে। অন্তত দু’মাস তো তার সঙ্গে সে প্রেম করেছে। দিল্লির বসন্ত কুঞ্জে ছিল রাজেশের বাড়ি। ওখান থেকে সোজা জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে অনুপমাকে উঠিয়ে প্রিয়া সিনেমার ক্যাফেতে বসে কাটাতো পুরো বিকেল। সন্ধ্যের পর প্রিয়া থেকে হাঁটতে হাঁটতে চলে যেত বসন্ত বিহারের এ ব্লকে অনুপমাদের বাড়ি। ওখানেই অনুপমার ঘরে বসে আবারও এক দফা চা হতো, চায়ের সঙ্গে চুমু হতো। চুমুই হতো, রাজেশ এর বেশি এগোতে চায়নি। ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার পর বসন্ত কুঞ্জেই এক ছোট কোম্পানির চাকরিতে ঢুকেছিল, কিন্তু মন বসাতে পারেনি। দেশে বিদেশে চতুর্দিকে চাকরির দরখাস্ত পাঠিয়েছিল রাজেশ। এর মধ্যে যা সে আশা করেনি তা হলো, চাকরি পেয়ে গেল আমেরিকার নিউ জার্সিতে। ইংরেজিতে অনার্স হয়েছে, এবার মাস্টার্সে ভর্তি হবে অনুপমা। কিন্তু রাজেশ বললো এইসব মাস্টার্স টাস্টার্স রাখো। আমি একা একা আমেরিকায় থাকবো না, বিয়ে করতে হবে, সঙ্গে যেতে হবে তোমাকে। অগত্যা তড়িঘড়ি বিয়ের আয়োজন করা হলো, বিয়ের রাতেই তাদের আমেরিকার বিমানে চড়তে হলো।
বিয়ের আগে নয়, বিয়ের পর খুঁটিয়ে দেখেছে সে অনুপমার শরীর, তার দোষ গুণ। অনুপমা ভার্জিন ছিল, এ কথা রাজেশ বিশ্বাস করে না। অনুপমা অবশ্য দাবিও করেনি সে ভার্জিন। এ নিয়েও তাদের মধ্যে তুমুল অশান্তি হয়েছে বেশ কয়েকদিন।
রাজেশ একদিন বলেছে –তুমি তো ভার্জিন ছিলে না।
অনুপমা উত্তর দিয়েছে–ছিলাম না, তাতে হয়েছেটা কী? বিয়ের আগে তো তুমি বলোনি, তুমি ভার্জিন চাও।
–আমি বলিনি, কিন্তু এক্সপেক্ট তো করেছিলাম যে তুমি ভার্জিন, আমি তো জানতাম বিয়ের আগে মেয়েরা ভার্জিনই থাকে।
–তুমি ভার্জিন ছিলে বিয়ের সময়?
–আমার কথা আসছে কেন?
–তোমার কথা আসবে না কেন? আমার কথা এলে তোমার কথাও আসবে। শোনো, তোমার ভার্জিনিটি ধুয়ে আমি জল খাবো না, আমার ভার্জিনিটি ধুয়েও তুমি জল খাবে না। এইসব সিলি কোশ্চেনগুলো যত কম করবে, তত ভালো। বিয়েটা টিকিয়ে রাখতে হলে কিছু স্বভাব পরিবর্তন করতে হবে তোমাকে, রাজেশ।
–আমাকে থ্রেট করছো?
–করছি।
–তুমি একটা সাধারণ লাইনে পড়া মেয়ে। মাস্টার্সও পাস করোনি। তুমি না ডাক্তার, না ইঞ্জিনিয়ার।
–সো?
–তোমার মতো মেয়েরা ছাপোষা কেরানির অ্যাসিস্টেন্টও হতে পারে না। কী নিয়ে অহংকার করো? না আছে রূপ, না আছে গুণ। আমাকে ডিভোর্স দিতে চাও? তোমাকে কে পুষবে শুনি। বাপের ঘরে তো ছ’মাসের বেশি থাকতে দেবে না।
–সে তোমাকে ভাবতে হবে না। আমার সহ্যের সীমা পেরোচ্ছে। তুমি একটা আনকালচার্ড, আনকুথ লোক। তুমি একটা লোভী, বর্বর। তোমার সঙ্গে এক ছাদের তলায় কী করে থাকছি, আমি নিজেই মাঝে মাঝে বুঝতে পারি না।

রাজেশ প্রথম অনুপমার শাড়িটি খুলে নিল শরীর থেকে। অনুপমার স্তন দুটো সুগোল এবং সুগঠিত, যাকে বলে ফার্ম। সন্তান জন্ম দিয়েছে, তারপরও সামান্যও হেলে পড়েনি। ষোলো বছর বয়সী মেয়েদের স্তনের মতো। অনুপমার বয়স কত ছিল বিয়ের সময়, সম্ভবত বাইশ, তারপর পাঁচ বছর পার হয়েছে, সাতাশ আঠাশ বছরের বেশি হবে না বয়স। এই স্তন নিশ্চয়ই রাজেশ ছাড়াও অন্য কেউ ছুঁয়েছে, নিশ্চয়ই এঁটো স্তন ছিল এ স্তন। না, এঁটো জিনিসের ওপর রাজেশের কোনও আকর্ষণ নেই। আকর্ষণ নেই, কিন্তু তারপরও রাজেশ লক্ষ্য করে স্তনদুটোর দিকে তাকিয়ে তার শরীরের ভেতরে আরেক শরীর ফুঁসে উঠছে। তার অস্থির উত্তেজিত পুরুষাঙ্গকে সে হস্তমৈথুন দিয়ে শান্ত করে। অনুপমার স্তন দুটো রাজেশের বীর্যে সাদা হয়ে থাকে। এরপর সে ছুরি হাতে নিয়ে এক একটা স্তনকে কেটে চার টুকরো করে। তারপর ছুরি ঢুকিয়ে দেয় যৌনাঙ্গে। এই যৌনাঙ্গে কে জানে কত লোক গমন করেছে। রাজেশ যে একাই এই যৌনাঙ্গের অধীশ্বর ছিল না, সে কারণে রাগ হয় তার, দাঁতে দাঁত ঘসতে থাকে ক্রোধে আর ঘৃণায়। নিউ জার্সির হোটেলে ফুলশয্যার রাতেই রাজেশ অনুপমাকে বেশ্যা বলে ডেকেছে। তার কাছে বেশ্যাই মনে হয়েছে তাকে। রাজেশ যৌবনে অন্তত কুড়ি পঁচিশটি মেয়ের সঙ্গে শুয়েছে, সে জানে ভার্জিনিটি কাকে বলে। একটি তেরো বছরের ভার্জিন কাজিনের সঙ্গে সঙ্গমের অভিজ্ঞতা তার আছে। কেদারনাথ মন্দিরের উদ্দেশে সবাই বেরিয়ে গেছে, গা-গরম নিয়ে হোটেলে শুয়ে ছিল কাজিন, আর ছিল ঘুমে অচেতন রাজেশ। ঘুম থেকে উঠে দেখে তাকে ছাড়াই পরিবারের লোকেরা বেরিয়ে গেছে। তখনই গা-গরম কাজিনের পাশে শুয়ে কুড়ি বছরের রাজেশের শরীর জেগে ওঠে। কাজিন রক্তাক্ত হয়ে গেল। রাজেশ তাকে বলে দিল, এ কথা কাউকে বললে রাজেশের কিচ্ছু হবে না, সর্বনাশ হবে কাজিনেরই। কাজিন দু’দিন টানা কেঁদেছে, জ্বর আরও বেড়েছে, কিন্তু কাউকে বলেনি কী ঘটেছে। রাজেশ ভালো করে জানে ভার্জিন কাকে বলে। রাজেশকে ধোঁকা দিতে অনুপমা পারেনি।

আমেরিকায় পাঁচ বছর চাকরি করার পর অর্থনৈতিক মন্দার কারণে রাজেশের চাকরি চলে গেল। কোম্পানিটি উঠেই গেল বলতে গেলে। ত্রিদিব চলে গেল ফিলাডেলফিয়ার এক কোম্পানিতে জয়েন করতে। রাজেশ দেশে ফিরে এলো। ফিরে এসে দিল্লিতে নয়, দেরাদুনে স্থায়ী হয়েছে। দেরাদুনের সাইনোটেক টেকনোলজিতে ভালো একটি চাকরি পেয়ে গেছে। আসলে রাজেশের সিভি দেখলেই মোটা অংকের অফার দেওয়া হয়, তাকে নেওয়ার জন্য কোম্পানিগুলোর মধ্যে কাড়াকাড়ি পড়ে যায়। দেরাদুনের সহস্রধারায় তার অফিস। বাড়িও একই অঞ্চলে। প্রাণ জুড়োয় প্রকৃতির এমন সৌন্দর্যের মধ্যে বাস করতে। তাকে প্রায়ই দেরাদুন থেকে কলকাতায় পাঠানো হয় সাইনোটেকের নতুন শাখা খোলার জন্য, সেখানেই স্বাতীর সঙ্গে দেখা। স্বাতী অনুপমার চেয়েও সুন্দরী, অনুপমার চেয়েও বয়সে ছোট, অনুপমার চেয়েও বড় ডিগ্রি তার, স্বাতীও তার মতোই ইঞ্জিনিয়ার, স্বাতীর বাবা অনুপমার বাবার চেয়েও ধনী। এই স্বাতীকে অপলক চোখে দেখে রাজেশ আর বলে তোমার সঙ্গে আর ছ’টা বছর আগে কেন আমার দেখা হলো না! স্বাতী হাসে। এত অপূর্ব হাসি রাজেশ আর দেখেনি কোনওদিন।

আমেরিকা থেকে ফেরার পর টাকা পয়সা হাতে প্রচুর ছিল। দেরাদুনের মুসৌরি রোডে একটি ভিলা কিনেছে রাজেশ। ভিলায় এখনও ওঠা হয়নি। ভেতরে নতুন ফার্নিচার বসানো হচ্ছে, দামি মার্বেল বসানো হচ্ছে মেঝেয়। ভাবছে স্বাতীকে নিয়েই উঠবে সে ওই ভিলায়। সিদ্ধার্থকে দিয়ে দেবে ডুন বোর্ডিং ইস্কুলে, সোনাক্ষীকে ইকোল গ্লোবাল বোর্ডিং-এ। অনুপমা কোথায়? অনুপমা দিল্লি গিয়েছিল। দিল্লিতে যদি না পৌঁছোয়, মাঝ পথে কী হয়েছে সে ধারণা রাজেশের নেই। দিল্লিতে কেন একা গেছে, রাজেশ কেন সঙ্গে যায়নি, যায়নি কারণ রাজেশের অফিসে ব্যস্ততা ছিল। দিল্লিতেই বা অনুপমার কী এমন দরকার ছিল, যে, বাচ্চা রেখে চলে গেছে? রাজেশের সঙ্গে আগের রাতে তুমুল ঝগড়া করেছে। রাজেশের দিকে টেবিল ল্যাম্প ছুঁড়েছে। শুধু টেবিল ল্যাম্প? হাতের সামনে যা পেয়েছে তাই ছুঁড়েছে। সকালে উঠে রাজেশকে বলেছে, দরজা বন্ধ করো, আমি যাচ্ছি। কোথায় যাচ্ছো? দিল্লি যাচ্ছি। কেন যাচ্ছো? না এর কোনও উত্তর সে দেয়নি। পরণে শাড়ি, কাঁধে একটি ব্যাগ, আর বড় একটি কালো রঙের স্যামসোনাইট সুটকেস ছিল হাতে। দরজায় দাঁড়িয়ে রাজেশ দেখলো একটি লাল রঙের গাড়ি দাঁড়ানো গেটের কাছে, সেই গাড়িতে উঠে চলে গেল অনুপমা। এরপর থেকে রাজেশ ফোন করছে, ফোন সুইচড অফ। খুব স্বাভাবিক ভাবেই রাজেশ ভেবে নিয়েছে অনুপমা বাপের বাড়ি গেছে, বাচ্চাদেরও তাই বলেছে।

এই গল্পটা স্বাতীকে ফোন করে বলে রাজেশ। স্বাতী শুনে অবাক। বাচ্চা ফেলে কোনও মা এভাবে চলে যায়! রাজেশ বললো, অনুপমা বাচ্চাদের দিকে তাকাতোই না। বেবি সিটাররাই বাচ্চা মানুষ করেছে। স্বাতী বললো, বুঝতে পারছি তুমি খুব টেনশনে আছো। শ্বশুর বাড়িতে ফোন করে কথা বলো ওয়াইফের সঙ্গে।
–ওহ স্বাতী, ওকে আমার আর ওয়াইফ ভাবতে ইচ্ছে করছে না। আমাকে শারীরিক মানসিক অত্যাচার অনেক দিন থেকেই করছে।
–সে কি একেবারে গেছে, নাকি কিছুদিনের জন্য গেছে?
–জানিনা, মনে হলো একেবারেই গেছে। আর ফিরবে না।
–ওর আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে কথা বলো।
–ও বাড়ির কারো সঙ্গে আমি কথা বলি না।
–তাহলে তো মুশকিল।
–স্বাতী তুমি দেরাদুনে চলে এসো। আমি ভীষণ ডিপ্রেশানে ভুগছি।
স্বাতী দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
স্বাতী কথা দেয়নি , কিন্তু যদি সত্যিই একদিন চলে আসে! তাই অনুপমাকে যত শীঘ্র সম্ভব নিশ্চিহ্ন করতে হবে। সারা রাত ধরে অনুপমার শরীর কেটেছে সে টুকরো টুকরো করে। গুণে দেখেছে মোট বাহাত্তরটি টুকরো হয়েছে। ভোরের দিকে প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরে ভরে অনুপমার সব হাড় মাংস ফ্রিজারে রেখে ফ্রিজার লক করে জেসমিন-লাইজল দিয়ে মেঝে মুছে দিয়েছে। হাত ধুয়ে নিয়েছে লাইফবয়ের হ্যাণ্ডওয়াশ দিয়ে। একটি একটি করে ব্যাগ বাইরে নিয়ে গিয়ে কোথাও কোনও নর্দমায় বা জলস্রোতে, বা জঙ্গলে বা খাদে ছুঁড়ে দিলেই অনুপমার কোনও চিহ্ন কোথাও আর থাকবে না। বালিশের তলায় ফ্রিজারের চাবিখানা রেখে কয়েক ঘণ্টা নিশ্চিন্তে ঘুমোয় রাজেশ।

খুব ভোরবেলায় রাজেশ বেরিয়ে পড়ে একটি প্লাস্টিকের ব্যাগ নিয়ে। গাড়ির ট্রাঙ্কে ব্যাগটি রেখে দেরাদুন মিসৌরি রোডে সে গাড়ি চালায়। যখন আশে পাশে কোনও পথচারী নেই, কোনও গাড়ি ঘোড়া নেই, তখনই ব্যাগটি সে ফেলে দেয় বড় নর্দমায়। স্রোতে ভেসে যায় অনুপমার মাংসপিণ্ডগুলো। এই ব্যাগে ছিল দু’পায়ের মাংস আর হাড়। রাজেশ মনে করতে চেষ্টা করে সে টুকরোগুলো গুণে ভরেছিল কিনা! পুরো শরীর থেকে যদি বাহাত্তর টুকরো বেরোয়, তাহলে দুটো পা আর দুটো উরু থেকে কত টুকরো বেরোবে। হিসেব করতে থাকে রাজেশ, আর ভোরের কুয়াশা ছিঁড়ে ছিঁড়ে গাড়ি এগোতে থাকে।

পরদিন আবার ভোরবেলা বেরোয় অনুপমার দু’বাহু, আর বুক পেট নিয়ে। নিয়ে যায় গভীর খাদের কাছে। ব্যাগটি খাদে ছুঁড়ে দিয়ে দূরের একটি মাঠে, যেখানে বেশ কিছু লোক শরীরচর্চার জন্য হাঁটছিল আর দৌড়োচ্ছিল, নেমে সে কিছুক্ষণ হাঁটে, কিছুক্ষণ দৌড়োয়, আর ভাবে প্রতি ভোরবেলায় এই মাঠে সে একঘন্টা হাঁটবে, দৌড়োবে, যোগ ব্যায়াম করবে। শরীরটার যত্ন তো নেওয়া উচিত। অনুপমা খাইয়ে খাইয়ে তাকে বেঢপ বানিয়ে ফেলেছে। এখন রাজেশ আবার তার যৌবন ফিরে পেতে চায়। এ তার নতুন জীবন। যথেষ্ট প্রাণশক্তি চাই এই জীবনে। কয়েক বছর বাদে সে সাইনোটেক কোম্পানির ডিরেক্টর হবে। স্বাতীর মতো কত রূপসী গুণবতী তখন পেছনে ঘুরঘুর করবে! আহ, অনুপমা যদি দেখতে পেত ডিরেক্টর রাজেশ গুলাটিকে! ডিরেক্টর হওয়ার পর অনুপমার বাহাত্তরটি টুকরো যদি জোড়া লাগিয়ে ওকে জ্যান্ত করা যেত! দেখতে পেতো, ত্রিদিব কতটা পারে, আর রাজেশ কতটা।

সোনাক্ষী আর সিদ্ধার্থ রাজেশের কাছে খুব বেশি ঘেঁষতো না, অনুপমাই ছিল তাদের জগত। কাজের লোকেরা ওদের যা খাইয়ে যায়, তা খেয়েই ওরা ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুম থেকে উঠে কেঁদে কেটে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। নিজেরাই ফ্রিজ থেকে যা নাগাল পায়, ক্ষিধে পেলে নিয়ে খায়। চার বছর সবে বয়স। নিজেরাও জানে না কখন কী খাবে। রাজেশ ক্ষিধে বলতে কিছু অনুভব করে না। লাঞ্চে, ডিনারে মদের বোতল নিয়ে বসে, সঙ্গে নেয় বাদাম বিস্কুট কিসমিস। অনুপমা রান্নাঘরের তাকে, ফ্রিজের তাকে এসব বেশ গুছিয়ে রেখেছে। কিছুই খুব বেশি খুঁজতে হয় না। রাজেশ জানে অনুপমা খুব গোছানো মেয়ে ছিল, সংসারটাকে নিজের ভাবতো। সিদ্ধার্থ আর সোনাক্ষী ভয়ে কাছে আসে না, তবুও সাহস করে এসে বলে গেছে, তারা তাদের মা’র সঙ্গে কথা বলতে চায়, মা’র কাছে চলে যেতে চায়, নয়তো মা’কে নিয়ে আসতে চায়, মা’কে ছাড়া তাদের ভালো লাগছে না। রাজেশ লক্ষ্য করে সোনাক্ষী আর সিদ্ধার্থর জন্য তার কোনও রকম ভালোবাসা নেই। এক সময় মনে হয় এ হয়তো তার সন্তান নয়। এ অন্য কারও সন্তান। নিউ জার্সিতে অনুপমা তো একাই বাইরে বেরোতো,ওদিকে সারাদিন অফিস করতো রাজেশ। হয়তো অনুপমা অন্য কারও সঙ্গে শুয়ে গর্ভবতী হয়েছিল। কে জানে হয়তো ত্রিদিবের সঙ্গেই। যে মেয়ে বিয়ের আগে ভার্জিনিটি খোয়াতে পারে, সে বিয়ের পরে সতীত্ব খোয়াতে দু’বার চিন্তা করে বলে রাজেশের বিশ্বাস হয় না। রাজেশের চেহারার সঙ্গে বাচ্চাদের চেহারার কোনও মিল নেই। আছে অনুপমার সঙ্গে মিল। এরা তাকিয়ে থাকলে রাজেশের মনে হতে থাকে অনুপমা তাকিয়ে আছে।

যখন তখন বাচ্চাদের কান্না রাজেশকে বড় বিরক্ত করে। মা নেই বলে মরাকান্না কাঁদে এরা। গিয়ে ক’টা চড় দিয়ে এলে কান্না বন্ধ হয়। এদেরকেও নিশ্চিহ্ন করতে ইচ্ছে করে রাজেশের। ইচ্ছে করে এ দুটোকেও টুকরো টুকরো করে ফ্রিজারে ঢুকিয়ে রাখতে।

পরদিন অনুপমার ভাই সুজন এসে নিয়ে যায় বাচ্চাদের। সুজন অবশ্য এসেছিল তার দিদির খোঁজে। অনেকদিন দিদি ফোন করেনি, আবার দিদিকে ফোন করলেও ফোন বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। সুজনকে সিদ্ধার্থ আর সোনাক্ষী দুজনই জানিয়েছে অনুপমা গেছে দিল্লিতে, নানার বাড়িতে। সুজন জানে অনুপমা সেখানে যায়নি। তবে কোথায় সে? রাজেশকে জিজ্ঞেস করাতে এমন সে অগ্নিমূর্তি ধারণ করে যে সুজন বিস্মিত হয়।
–কী ব্যাপার, এত রাগ কার ওপর?
–কার ওপর আবার? তোমার দিদির ওপর। সে কতটা কাণ্ডজ্ঞানহীন বলো, বাচ্চাদের রেখে বাপের বাড়ি চলে গেল! এরা কী খাবে, কী পরবে, তা দেখবে কে? আমার অফিস নেই? অফিস থেকে ছুটি নিয়ে এদের দেখতে হচ্ছে। এভাবে কামাই করলে চাকরিটা তো যাবে আমার!
–কিন্তু বাপের বাড়ি তো দিদি যায়নি!
–তাহলে খোঁজ নাও, কোনও প্রেমিকের সঙ্গে ভেগেছে বোধহয়। বলে তো গেছে বাপের বাড়ি যাচ্ছে। গত রোববার একটা লাল গাড়ি এসে ওকে নিয়ে গেছে সকালের দিকে। একটা ভদ্রলোক গাড়ি চালাচ্ছিল, দূর থেকে মুখটা ভালো করে দেখতে পাইনি। এই লোকের সঙ্গেই হয়তো সম্পর্ক ছিল। হয়তো আবার কী, এর সঙ্গেই ছিল, এরই ঘন ঘন ফোন আসতো।
–কী আশ্চর্য! দিদি এরকম একটা কাণ্ড ঘটাবে!
–অনেক সয়েছি, এবার ওকে আমি ডিভোর্স দেবই।
সুজন আর দেরি করে না, সোনাক্ষী আর সিদ্ধার্থকে নিয়ে সে বেরিয়ে যায়। এতে স্বস্তি হয় রাজেশের। এর মধ্যে স্বাতীর ফোন, স্বাতী অভিনন্দন জানালো রাজেশকে, এ বছর কলকাতার অফিস থেকে এক্সট্রা অরডিনারি কাজের জন্য রাজেশকে সোনার মেডেল দেওয়া হচ্ছে । স্বস্তি, তার ওপর আনন্দ। এবার অনুপমার কাটা মাথাটা কোথাও ফেলে এলেই তার আর কোনও চিন্তা নেই। বাড়ি খালি হয়ে যাওয়ার পর, সে দরজা জানালা সব বন্ধ করে বাড়ি অন্ধকার করে ফেলে, কাটা মাথাটা ফ্রিজার থেকে বের করে নিয়ে আসে, খাবার টেবিলের মাঝখানে রেখে তুমুল হাসে সে, বলে, ‘কী গো, দেখছো তো কী হচ্ছে? এ বাড়ি থেকে সবাইকেই বিদেয় হতে হলো। তোমাকে, তোমার বাচ্চাদের। তোমার কোন প্রেমিকের বাচ্চা জন্ম দিয়েছো, সে তুমিই জানো। সিদ্ধার্থকে তো দেখতে অনেকটা ত্রিদিবের মতো। ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম, কাল তো সেরকমই মনে হলো। আমাকে ডিভোর্স দিতে চেয়েছিলে তুমি, আমি নাকি ভালো লোক নই, আমি নাকি তোমাকে মানসিক অত্যাচার করি! সমস্ত অত্যাচার থেকে এখন তো তুমি মুক্ত, তোমার তো সুখে থাকার কথা। আজ তোমার মুণ্ডুটাকে নদীতে ডুবিয়ে দিয়ে এসেই আমি শুরু করবো আমার নতুন জীবন।
রাজেশ থেমে এক কাপ চা বানিয়ে নিয়ে আসে।। চা থেকে ধোঁয়া উড়ে রাজেশের দু’চোখ ঢেকে যায়। দীর্ঘ একটি শ্বাস ছেড়ে সে বলে, ‘অনুপমা, তোমাকে আমি ভালো বাসিনি তা নয়, বেসেছিলাম। তুমি চমৎকার মেয়ে ছিলে, বুদ্ধিমতী ছিলে, সংসারের সবকিছু একা সামলাতে। কিন্তু তোমার ওই আত্মসম্মানবোধ, ওটাই আমাকে ছিঁড়ে খেয়ে ফেললো। ওটা আমি সহ্য করতে পারিনি। ওটা যদি তোমার না থাকতো, তাহলে ঝগড়া করারও দরকার হয়না, তোমার গায়েও আমার হাত তোলার দরকার হয় না, তোমার মুখকে এভাবে বালিশ চাপা দিয়ে বন্ধ করারও আমার দরকার হয় না। যে মেয়েদের এই জিনিসটা আছে, এই আত্মসম্মানবোধ, তাদের বিয়ে করা উচিত নয়। আমি জানিনা স্বাতীকে বিয়ে করা আমার ঠিক হবে কিনা, আমার মনে হয় স্বাতীরও ওই জিনিসটা তোমার মতোই আছে, ওই আত্মসম্মানবোধ।

অনুপমার ফ্রোজেন কাটা মাথাটাকে ফ্রিজারে রেখে দিয়ে এরপর রাজেশ মধ্যরাত হওয়ার অপেক্ষা করে। ঝিঁঝিঁ ডাকতে শুরু করলেই সে মাথাটাকে নিয়ে বেরোবে।

মন্তব্য

আরও দেখুন

নতুন যুগ টিভি