বিশ্ব মা দিবস

নিরাপদ মাতৃত্ব মায়ের অধিকার

সর্বমোট পঠিত : 450 বার
জুম ইন জুম আউট পরে পড়ুন প্রিন্ট

আজ বিশ্ব মা দিবস। 'মা' শব্দের মধ্যেই পৃথিবীর সব ভালোবাসা, আবেগের সম্মিলন। পৃথিবীর সব মানুষের মনে রয়েছে মায়ের প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা। মায়ের অনুগ্রহ ছাড়া কোনো প্রাণীরই প্রাণ ধারণ করা সম্ভব নয়। সে মায়ের নিরাপদ মাতৃত্ব নিয়ে আমরা কতটুকু যত্নবান হই? লিখছেন গোলাম কিবরিয়া

আজ বিশ্ব মা দিবস। 'মা' শব্দের মধ্যেই পৃথিবীর সব ভালোবাসা, আবেগের সম্মিলন। পৃথিবীর সব মানুষের মনে রয়েছে মায়ের প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা। মায়ের অনুগ্রহ ছাড়া কোনো প্রাণীরই প্রাণ ধারণ করা সম্ভব নয়। সে মায়ের নিরাপদ মাতৃত্ব নিয়ে আমরা কতটুকু যত্নবান হই? লিখছেন গোলাম কিবরিয়া

আমরা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ঝড়ের রাতে নিজের জীবন বাজি রেখে ভরা দামোদর সাঁতরে পাড়ি দেওয়ার গল্পও পড়েছি; কেবল অসুস্থ মায়ের কাছে পৌঁছানোর জন্য। শৈশবে পড়া কবি কালিদাস রায়ের 'মাতৃভক্তি' কবিতায় আমরা দেখেছি, একজন সন্তান মায়ের ঘুম ভাঙার অপেক্ষায় সারারাত কীভাবে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন জলভর্তি গ্লাস হাতে করে। কিন্তু বর্তমানে আসলেই আমরা একজন মাকে নিয়ে কতটা আন্তরিকতার সঙ্গে ভাবি? যে মা অনেকটা কষ্ট সহ্য করে একজন সন্তান গর্ভধারণ করেন, সে মায়ের নিরাপদ মাতৃত্ব নিয়ে আমরা কতটুকু যত্নবান হই। দেশে এখনও সম্পূর্ণ নিরাপদ মাতৃত্বের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি।

মাতৃস্বাস্থ্য একজন মহিলার গর্ভাবস্থা, প্রসব অবস্থা ও প্রসবোত্তর সময়ের স্বাস্থ্য অবস্থা। এই সেবার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে- পরিবার পরিকল্পনা, গর্ভকালীন সেবা, প্রসবকালীন সেবা ও প্রসবোত্তর সেবা। জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের মতে, ২০১০ সালে দুই লাখ ৮৯ হাজার মহিলা শুধু গর্ভাবস্থায় ও প্রসবাবস্থায় মারা গিয়েছেন। দিনে দিনে এই মাতৃমৃত্যুর হার কমে এলেও আফ্রিকার কিছু দেশ এবং দক্ষিণ এশিয়ার কিছু দেশে এই হার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েই চলছে।

সাভারের মাঝিপাড়া একটি গ্রাম, যা সাভারের একটু ভেতরে অবস্থিত। এটি একটি সংখ্যালঘু পাড়া, যেখানে প্রায় প্রতিটি ঘরের মেয়েকে বয়ঃসন্ধিকালে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। যে বয়সে তারা স্কুলে যাবে, পড়াশোনা করবে, খেলাধুলা করবে, একটু সুন্দর শৈশব ও কৈশোর কাটাবে- ঠিক সেই বয়সে তাদের সংসার নামক বাঁধনে বেঁধে দেওয়া হয়। শুধু তাই নয়, বিয়ের বছর না ঘুরতেই তারা সন্তান জন্ম দেয়। এই গ্রামেই নারীদের গর্ভাবস্থার নিরাপত্তা ও ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছেন দয়িতা ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা নূপুর আক্তার নোভা। তিনি বলেন, 'আমরা যখন সেখানে তাদের নিয়ে কাজ করতে যাই, তখন একটি ভয়াবহ সত্যের মুখোমুখি হই। একটি ১৪ বছরের কিশোরী, তাকে বিয়ে দেওয়া হয় এবং এক বছরের মধ্যেই সে সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়ে। সন্তান জন্মদানের সময়ে তার মৃত্যুঝুঁকি তো হয়ই, অপরিণত বয়সে সন্তান জন্মদানের হেতু তার সন্তানটি মারা যায়।

এটুকু বয়সে একটি কিশোরী কতটা ভয়ানক অভিজ্ঞতার শিকার হয়। যখন আমরা তাদের এই বিষয়ে বিস্তারিত বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করি, তখন তাদের অনেকেই এতে আপত্তি প্রকাশ করেন। কিন্তু পরে একটি ১৬ বছরের মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছিল। পরে তাকে ডেকে তাদের সামনে দাঁড় করিয়ে যখন খুব সূক্ষ্ণভাবে প্রতিটি ক্ষতিকারক দিক তুলে ধরি এবং বোঝাই যে শিক্ষার অভাবে জলদি বিয়ে দেওয়া ও অপরিণত বয়সে সন্তান জন্মদানের ফলে ক্ষতিটা শুধু তাদের সন্তানের হবে, তখন তারা কিছুটা বোঝেন। তারা এটাও বলেন, মেয়েদের স্কুল দূরে হওয়ায় অনেকটা সমস্যা হয়। তা ছাড়া আসা-যাওয়ার সময় অনেকেই হেনস্তার শিকার হয়, তখন তারা বাধ্য হয়ে পড়াশোনা বন্ধ করে দেন। তখন আমরা তাদের এর থেকে প্রতিকারের বিষয়গুলো তুলে ধরি। মাতৃস্বাস্থ্য ঝুঁকির সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবেই মনে করা হয় অল্প বয়সে বিয়ে ও অল্প বয়সে গর্ভধারণকে। এ সমস্যা সমাধানে সে গ্রামে নোভা তাদের বোঝানোর চেষ্টা করেন ১৮ বছরের আগে বিয়ে নয়; বরং এই সময়টা তাদের শিক্ষা ও মানসিক বিকাশের সময়।

নোভা বলেন, 'আমরা তাদের মধ্যে স্বাস্থ্য, মাসিক, বাল্যবিবাহ সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছি। তারা আমাদের আশ্বস্ত করেছেন, ১৮ বছরের আগে তারা তাদের সন্তানকে বিয়ে দেবেন না এবং শিক্ষা গ্রহণে সাহায্য করবেন। আমাদের সেই দিনের প্রজেক্টের পর তাদের মাঝে আগের থেকে অনেক পরিবর্তন এসেছে এবং আসার কথা হচ্ছে, এখন পর্যন্ত তাদের মধ্যে কেউ বাল্যবিবাহ দেননি।' গর্ভকালীন মাতৃস্বাস্থ্যের নিরাপত্তায় পরিবারের ভূমিকা কতটুকু- এ বিষয়ে জানতে চাইলে কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টারের আলট্রাসনোলজিস্ট ডা. আয়েশা হোসেন সাদিয়া বলেন, 'মাতৃস্বাস্থ্যের নিরাপত্তায় পরিবারের ভূমিকা অতি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, একজন সুস্থ-সবল গর্ভবতী মা সুস্থ বাচ্চা জন্ম দিতে পারেন। গর্ভকালীন হরমোনজনিত অসমতার একজন গর্ভবতী মায়ের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলে। এ ক্ষেত্রে পরিবারের তার শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি অনেক বেশি যত্নবান হতে হবে। তাকে সব ধরনের সহায়তা করতে হবে। অনেক সময় লজ্জায় অনেক গর্ভবতী মা তার অনেক প্রয়োজনের কথা বলতে পারেন না। সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। পরিবারের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান হচ্ছে স্বামীর। অন্য সব সদস্যের প্রতি, মায়ের প্রতি যত্নবান হতে হবে এবং সহায়তা করতে হবে সব ধরনের। কারণ, গর্ভবতী মায়ের পরিবার ইতিবাচক হলে গর্ভবতী মহিলার সুস্থতার জন্য ইতিবাচক প্রভাব অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে গর্ভকালে।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের 'মনে পড়া' কবিতায় আমরা যে মায়ের ছবি দেখি, সেখানে কবি পূজার গন্ধের সঙ্গে মায়ের গন্ধ পান, আশ্বিনের শিউলিবনে ভোরের শিশিরের সঙ্গে মায়ের মুখ কবির স্মৃতিতে ভাসে। আদতে মায়েরা গৃহকর্মের বাইরে সবার সেবায় নিজেদের জীবন উৎসর্গ করতেন। আমাদের গ্রামবাংলার মায়েদের এটিই সাধারণ ছবি।

কবি শামসুর রাহমান তার 'কখনও আমার মাকে' কবিতায় লিখেছেন, গুরুজনদের ভয়ে হয়তো কখনও তার মায়ের মনে কোনো গান গেয়ে ওঠার সাহস পায়নি। কিংবা স্বামীর সংসারে এসেও কাজের ফাঁকে কখনও গান গাইতে শোনেননি। কাজী নজরুল ইসলামের 'মা' কবিতায় তিনি বলেছেন, 'হেরিলে মায়ের মুখ, দূরে যায় সব দুখ। মায়ের কোলেতে শুয়ে জুড়ায় পরাণ। মায়ের শীতল কোলে সকল যাতনা ভোলে কত না সোহাগে মাতা বুকটি ভরান। সন্তানের মুখ চেয়ে তিনি উপবাসও থাকেন। কেননা তিনি যে মা।' মাকে সব সময়ই কোমল আর আত্মত্যাগী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন সবাই। কিন্তু সেই মায়েরও যে সব মানুষের মতোই সকল মৌলিক চাহিদা সমানভাবে পাওয়ার অধিকার আছে, তা যেন প্রায়ই এ সমাজ ভুলে যায়।

রাষ্ট্রীয়ভাবে সমাজে নারী-পুরুষের বৈষম্য কমিয়ে আনতে না পারলে নারী কখনোই মর্যাদার অধিকারী হবে না।

একজন গর্ভবতী মায়ের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা আমাদের সবার দায়িত্ব। নিরাপদ মাতৃস্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে দেশের সর্বস্তরে চালু আছে বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রম। বাড়ি গিয়ে গর্ভবতী নারীদের স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে যাচ্ছেন এফডব্লিউভি, বিভিন্ন স্তরের স্বাস্থ্যসেবা কর্মীরা। পল্লি এলাকায় চালু হয়েছে কমিউনিটি ক্লিনিক, স্যাটেলাইট ক্লিনিক, এফডব্লিউসিসহ নানা রকম স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম। যার দরুন গর্ভাবস্থায় কমপক্ষে চারটি চেকআপের জন্য উদ্বুদ্ধ করা সম্ভব হচ্ছে- প্রথমটি গর্ভবতী হওয়ার পর যত দ্রুত সম্ভব, দ্বিতীয়টি ৪-৬ মাসের মধ্যে, তৃতীয়টি ৮ মাস, চতুর্থটি ৯ মাস। গর্ভাবস্থায় ৫টি বিপদচিহ্ন নিয়ে বিভিন্ন জনসচেতনতামূলক কার্যক্রমও চালু আছে।

-ডা. রেফায়াত যোবয়রা প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ

মন্তব্য

আরও দেখুন

নতুন যুগ টিভি