ফিচার

করোনা কালে মু’মীনের করণীয়

ড. আবদুল আলীম তালুকদার
সর্বমোট পঠিত : 101 বার
জুম ইন জুম আউট পরে পড়ুন প্রিন্ট

ড. আবদুল আলীম তালুকদার পৃথিবী সৃষ্টির প্রারম্ভ থেকে কোনো নির্দিষ্ট এলাকায় বা কখনও কখনও সারাবিশ্বব্যাপী মানব জাতি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরনের সংক্রামক ব্যাধি তথা মহামারীর (প্লেগ, যক্ষা, কুষ্ঠ, কলেরা, বসন্ত, ইনফ্লুয়েঞ্জাপ্রভৃতি) সম্মুখীন হয়েছে যা বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ ও ইতিহাস দ্বারা প্রমাণিত।


ড. আবদুল আলীম তালুকদার

পৃথিবী সৃষ্টির প্রারম্ভ থেকে কোনো নির্দিষ্ট এলাকায় বা কখনও কখনও সারাবিশ্বব্যাপী মানব জাতি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরনের সংক্রামক ব্যাধি তথা মহামারীর (প্লেগ, যক্ষা, কুষ্ঠ, কলেরা, বসন্ত, ইনফ্লুয়েঞ্জাপ্রভৃতি) সম্মুখীন হয়েছে যা বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ ও ইতিহাস দ্বারা প্রমাণিত। যেমন- খ্রিস্টপূর্ব ৪৩০ অব্দে প্লেগ অব এথেন্স, ৫৪১ খ্রি. শুরু হয়ে প্রায় দুই শতাব্দী ব্যাপী চলে জাস্টিনিয়ান প্লেগ, ষষ্ঠ শতক থেকে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত দাপিয়ে বেড়ানো গুটি বসন্ত, ১৩৪৬ খ্রিস্টাব্দে ইউরোপের অন্যতম প্রাণসংহারী মহামারী ব্ল্যাক ডেথ, ১৮১৭-১৮২০ খ্রিস্টাব্দে চলা কলেরা মহামারী, ১৯১৮-১৯২০ খ্রি.চলা স্প্যানিশফ্লু, ১৯৫৭-১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দের এশিয়ান ফ্লুছাড়াও এইচআইভি, সার্স, ইবোলা এবং সাম্প্রতিক কালের কোভিড-১৯ (নভেল করোনা ভাইরাস) অন্যতম। অধিকাংশ গবেষক ও ইতিহাস বেত্তাদের মতে, প্রতিশত বছরে পৃথিবী একবার মহামারীর কবলে পড়ে। মহাগ্রন্থ আলকুরআন ও হাদীসে রাসূলে এসব মহামারী ও বালা-মুসিবতকে মানব সম্প্রদায়ের কৃতকর্মের ফল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বর্তমানে সারা দুনিয়ার বনিআদমকে নাস্তানাবুদ করছে যে নভেল করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) এটাও মনুষ্য জাতির অনাচার-দূরাচার, অশ্লীলতা, পাপ-পঙ্কিলতার ফসল। মানুষ যখন বেশি বেপরোয়া হয়েসীমা অতিক্রম করে ফেলে, বেশুমার পাপাচারে লিপ্ত হয় তখন মহান আল্লাহ্ বান্দাকে সতর্ক করতে বিভিন্ন প্রকার বালা-মুসিবত, আযাব-গযবে নিপতিত করে পরীক্ষায় ফেলেন যাতে করে তাঁর বান্দারা গুণাহের কাজ থেকে নিবৃতহন। দূরাচার ফেরাউন-নমরুদকে আল্লাহ্তা‘আলা তখন ইশাস্তি দিয়েছেন, যখন সে নিজেকে সৃষ্টিকর্তা বলে দাবি করেছে। অনুরূপ ভাবে ‘আদ, সামুদ, মাদইয়ান প্রভৃতি জাতিকে তাদের সীমাহীন পাপের কারণে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে।এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্তা‘আল পবিত্র কুরআনের সূরা রূমের ৪১ নং আয়াতে ইরশাদ করেন, ‘মানুষের কৃতকর্মের ফলে জলে ও স্থলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়ে; যার ফলে তাদের কৃতকর্মের কোনো কোনো কর্মের শাস্তি তাদেরকে তিনি আস্বাদন করান, যাতে তারা প্রত্যাবর্তন করে।’ সূরা আন আমের ৪২ নং আয়াতে আল্লাহ্তা‘আলা ইরশাদ করেন, তারপর আমি তাদের উপর রোগ ব্যাধি, অভাব, দারিদ্র, ক্ষুধা চাপিয়ে দিয়েছিলাম, যেন তারা আামার কাছে নম্রতাসহ নতি স্বীকার করে। সূরা বাক্বারার ২৬ নং আয়াতে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন, নিশ্চয়ই আল্লা হ্মশা কিংবা তদপেক্ষাক্ষুদ্র/তুচ্ছ বিষয় (ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়া বা জীবাণু) দিয়ে উদাহরণ বা তার নিদর্শন প্রকাশ করতে মোটেও লজ্জা বোধ করেননা। সূরা‘আরাফের ৯৪ নং আয়াতে আল্লাহ্তা‘আলা ইরশাদ করেন, ওর অধিবাসীদের আমি দুঃখ, দারিদ্র্য, রোগব্যাধি এবং অভাব-অনটন দ্বারা আক্রান্ত করে থাকি। উদ্দেশ্য হলো তারা যেন নম্র এবং বিনয়ী হয়। সূরা‘আরাফের ১৩৩ নং আয়াতে আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেন, শেষ পর্যন্ত আমি এই জাতিকে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পোকা মাকড় বা পঙ্গপাল, উকুন, ব্যাঙ, রক্ত, প্লাবন ইত্যাদি দ্বারা শাস্তি দিয়ে কষ্ট ভোগ করাই। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ্ (স.) ইরশাদ করেছেন, যখন কোনো কওমের মধ্যে অশ্লীলতা-বেহায়াপনা ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ে এবং তারা তা প্রকাশ্যেও করতে শুরু করে তখন তাদের মাঝে এমন রোগব্যাধি মহামারী ছড়িয়ে পড়ে, যা ইতি পূর্বে কখনো দেখা যায়নি। (ইবনেমাযাহ: ৪০১৯) হযরতআয়েশা (রা.) বর্ণনাকরেছেন, আমিরাসূলুল্লাহ্ (স.) কে মহামারীসম্পর্কে জিজ্ঞেসকরি। তিনিউত্তরেবলেন, এটাএকটিআযাব। আল্লাহ্তা‘আলাযাদেরকাছেইচ্ছা প্রেরণকরেন।আল্লাহ্তা‘আলামু’মীনদের জন্য এটাকেরহমতবানিয়েছেন।তাইযখন কোনো ব্যক্তি মহামারিতেপতিত হয় এবং নেকীরআশায় সে ধৈর্যসহকারে সেখানে অবস্থানকরেএবং এ বিশ্বাসরাখে যে, আল্লাহ্তা‘আলারহুকুমব্যতীতকিছুই হয় না, তাহলে সে শহীদেরসওয়াবলাভকরবে। (বুখারীশরীফ : ৫৪০২) হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ্ (স.) বলেছেন, মহামারীর কারণে মারা যাওয়া প্রতিটি মুসলিমের জন্য শাহাদাত। (বুখারী : ২৮৩০) গবেষকদের মতে, বেশির ভাগ মহামারীই সংক্রামক। তাইনবী (স.) মহামারীর সংক্রমণ রোধে আক্রান্ত অঞ্চলে যাতায়াত নিষিদ্ধ করেছেন। তাই মহানবী (স.) বলেছেন, যখন তোমরা কোথাও মহামারীর সংবাদ পাবে তখন সে দিকে যেওনা। আর যদি তোমরা মহামারীতে আক্রান্ত ভূমিতে পূর্ব থেকেই অবস্থান করো তাহলে সেখান থেকে পালিয়ে যেওনা। (বুখারী : ৫৭৩৯, মুসলিম: ২২১৯) এছাড়াও সূরা বাক্বারার ১৫৫ নং আয়াতে আল্লাহ্ তাআলা ইরশাদ করেন, আর আমি অবশ্যই তোমাদেরকে কিছু ভয়, ক্ষুধা, জান-মালের ক্ষতি এবং ফল-ফলাদির স্বল্পতার মাধ্যমে পরীক্ষা করব। তবে তুমি ধৈর্যশীলদেরকে জান্নাতের সুসংবাদ দাও। তাই বিপদ-আপদ, বালা-মুসিবতে মু’মীনের আতঙ্কিত হওয়ার কিছুই নেই। কেননা মুমীনবান্দা সর্বদা আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করে থাকে। আর বান্দাহ্ যখন আল্লাহ্তা‘আলার হুকুম ও রাসূল (স.)-এর প্রদর্শিত পথে চলে তখন তার জীবন হয় চিন্তা মুক্ত। কেননা আল্লাহ্তা‘আলা সূরা ইউনূসের ৬২ নং আয়াতে ইরশাদ করেন, জেনে রাখো, আল্লাহর ওলী তথা বন্ধুদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না। হযরত আবুহুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ্ (স.) বলেছেন, এমন কোনো রোগ নেই যা আল্লাহ্তা‘আলা সৃষ্টি করেননি। আরতিনি এর প্রতিষেধকও সৃষ্টি করেছেন। (বুখারী: ৫৬৭৮) অতএব মহামারী থেকে বেঁচে থাকতে হাদীসে ঘোষিত নিম্ন লিখিত দু‘আ গুলোও আমলকরা যেতে পারে। হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত। (যে কোনো রোগ-শোক, বালা-মুসিবত-বিপদ থেকে রক্ষা পেতে)নবী (স.) পড়তেন- আল্লাহুম্মা ইন্নি আউযুবিকা মিনাল বারাসিওয়াল যুনুনি ওয়াল যুযামি ওয়ামিন সায়্যিয়িল আসক্বাম। (আবু দাউদ: ১৫৫৪) রাসূলুল্লাহ্ (স.) আরো বলেছেন, যে ব্যক্তি সন্ধ্যায় তিন বার বলবে- ‘বিস্মিল্লাহিল্লা জিলাইয়া দুররুমা আসমিহিশাইউন ফিল আরদি ওয়ালা ফিস্সামায়ি ওয়া হুয়াস্সামিউল আলীম।’সকাল হওয়া পর্যন্ত ওই ব্যক্তির উপর আকস্মিক কোনো বিপদ আসবে না। আর যে ব্যক্তি সকালে তিনবার এ দু‘আ পড়বে সন্ধ্যা পর্যন্ত তার উপর কোনো বিপদ-আপদ, মহামারী আসবেনা। (তিরমিযি : ৩৩৮৮) এছাড়াও এই মহামারী থেকে পরিত্রাণ পেতে তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করে দু‘আকরা যেতে পারে। এ মর্মে রাসূলুল্লাহ্ (স.) বলেছেন, ‘তাহাজ্জুদের সালাত শরীরের যাবতীয় রোগ বালাই দূর করে।’আর সাধ্যানুযায়ী বেশি বেশি দান-সাদকাহ্ করা, বেশি বেশি তাওবা ইস্তিগফার পড়া, পিতা-মাতার সেবা-সুশ্রƒষাকরা, পরিবার-পরিজন, আত্মীয়স্বজন-পাড়া প্রতিবেশির সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা ও সর্বদা সৎকর্ম করার চেষ্টা করা। নবী (স.) বলেছেন, দান-সাদকা ও সৎকর্ম অপমৃত্যু থেকে রক্ষা করে। তাছাড়াও যে কোনো ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়া তথা জীবাণু থেকে নিরাপদ থাকতে ঈমানের অন্যতম অঙ্গ ত্বাহারাত তথা পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার কোনো বিকল্প নেই। আর তার সাথে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিওএইচও) এবং সরকারি সংস্থা আইইডিসিআর কর্তৃক নির্দেশিত বিধি-নিষেধ তো মানতেই হবে। যেমন- অসুস্থ হলে ঘরে থাকতে হবে। বাড়ি থেকে বাইরে বের হওয়া অত্যাবশ্যক হলে অবশ্যই মাস্ক পরিধান করতে হবে এবং শারীরিক দূরত্ব মেনে চলতে হবে। অপ্রয়োজনে বাড়ির বাইরে যাওয়ার অভ্যাস পরিহার করতে হবে। কিছুক্ষণ পর পর সাবান পানি দিয়ে কমপক্ষে২০ সেকেন্ড ধরে ভালোভাবে হাত ধুতে হবে অথবা হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে স্যানিটাইজ করতে হবে। হাঁচি-কাশি দেওয়ার পর অবশ্যই হাত ধুয়ে ফেলতে হবে এবং হাঁচি-কাশি দেওয়ার সময় কনুই ব্যবহার করতে হবে অথবা টিস্যু বারুমাল দিয়ে নাক-মুখ ঢেকে ফেলতে হবে। ব্যবহৃত টিস্যুটি সঠিক জায়গায় ফেলার অভ্যাস করতে হবে। পারত পক্ষে নাক, মুখ, চোখ ও কানে হাতের স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। আর যত্রতত্র কফ, কাশি, থুথু ফেলা থেকে নিবৃত থাকতে হবে। আল্লাহ্তা‘আলা মানব জাতিকে সকল প্রকার মুসিবত থেকে রক্ষাকরুন।  লেখক: সহকারী অধ্যাপক, শেরপুর সরকারি মহিলা কলেজ, শেরপুর

মন্তব্য

আরও দেখুন

নতুন যুগ টিভি