'দ্বিতীয় প্রজন্ম' শুরু হয়েছিল হাবিবুল বাশার, আশরাফুলদের সঙ্গে তামিম, সাকিব, মুশফিকদের সংযোজনে

বাঁধ ভেঙেছে তৃতীয় প্রজন্ম

এবাদত হোসেন চৌধুরী
সর্বমোট পঠিত : 227 বার
জুম ইন জুম আউট পরে পড়ুন প্রিন্ট

ওই সফরে অতিথি হয়েই দলের সঙ্গে ছিলেন এবাদত। সে নিউজিল্যান্ডেই হ্যামিলটনে টেস্ট অভিষেক হয়েছিল তার ২০১৯ সালের মার্চে। কিন্তু গত সাড়ে তিন বছরেও খবরে সত্যিই সেভাবে আসেননি তিনি। তবে যেদিন এলেন সেদিন সত্যিই তার খবর খুব চলছে বাজারে। কলকাতার এক বন্ধু সাংবাদিক হোয়াটসঅ্যাপে জানাতে চাইছিলেন, ছেলেটির বাড়ি কোথায়? সে নাকি বিমানবাহিনীর সদস্য? করোনার সময় নাকি পাহাড়ে চড়ে ফিটনেস ধরে রাখতেন? বাংলাদেশের গি ছাড়িয়েও এবাদতকে নিয়ে প্রবল আগ্রহ বিশ্ব ক্রিকেটে। অবশ্য হবে নাই বা কেন- গত বাইশ বছর ধরে প্রজন্মের পর প্রজন্ম যেখানে গিয়ে শুধু হেরেই এসেছে, সেখান থেকে জয় তুলে আনার নায়ককে নিয়ে পেজ থ্রির স্টোরিই বা কেন হবে না?

কেন জানি সেদিনের কথাটি খুব মনে পড়ছে এখন। সেবার নেপিয়ারে সাগরের গা ঘেঁষা হোটেলে ছিল বাংলাদেশ দল। সন্ধ্যা নামার আগে বিচের সামনে ভিড় জমে যেতে অনেক। তার মধ্যে দু-একজন বাংলাদেশি ক্রিকেটারেরও দেখা মিলত। সংবাদের খোঁজে ঢাকা থেকে যাওয়া সাংবাদিকদের কেউ কেউ ওই সময়টাতে তাক করে থাকতেন। তা একদিন তেমনই গোধূলি বেলায় ধরা দিল একা একা মোবাইলে ছবি তুলছেন এবাদত হোসেন। কাছে গিয়ে গল্পচ্ছলে খবরের মধ্যে ঢোকার চেষ্টা করতেই বুঝে গেলেন তিনি। 'আমাকে নিয়ে লিখে কী হবে, আমার খবর কেউ খাবে না...।' খাবে না- মানে? 'খাবে না মানে খাবে না, যেদিন দলে সুযোগ পাব, দলকে জেতাতে পারব, এই নিউজিল্যান্ড থেকে আপনাদের জয় উপহার দিতে পারব, সেদিন দেখবেন আমার খবরই খুব খাবে...।' ২০১৭ সালের জানুয়ারির কোনো এক বিকেলে বলা এবাদাতের সেই 'খাবে না...' কথাটিই কানে বাজছে। সেবার তাকে টেস্ট স্কোয়াডে না রাখা হলেও কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহের ইচ্ছের কারণে দলের সঙ্গে সফরসঙ্গী করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল, নেটে বোলিং করার পাশাপাশি ড্রেসিংরুমের পরিবেশ কাছ থেকে দেখা। হাথুরু চেয়েছিলেন তখন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের পেস ইউনিট তৈরি করার।

ওই সফরে অতিথি হয়েই দলের সঙ্গে ছিলেন এবাদত। সে নিউজিল্যান্ডেই হ্যামিলটনে টেস্ট অভিষেক হয়েছিল তার ২০১৯ সালের মার্চে। কিন্তু গত সাড়ে তিন বছরেও খবরে সত্যিই সেভাবে আসেননি তিনি। তবে যেদিন এলেন সেদিন সত্যিই তার খবর খুব চলছে বাজারে। কলকাতার এক বন্ধু সাংবাদিক হোয়াটসঅ্যাপে জানাতে চাইছিলেন, ছেলেটির বাড়ি কোথায়? সে নাকি বিমানবাহিনীর সদস্য? করোনার সময় নাকি পাহাড়ে চড়ে ফিটনেস ধরে রাখতেন? বাংলাদেশের গি ছাড়িয়েও এবাদতকে নিয়ে প্রবল আগ্রহ বিশ্ব ক্রিকেটে। অবশ্য হবে নাই বা কেন- গত বাইশ বছর ধরে প্রজন্মের পর প্রজন্ম যেখানে গিয়ে শুধু হেরেই এসেছে, সেখান থেকে জয় তুলে আনার নায়ককে নিয়ে পেজ থ্রির স্টোরিই বা কেন হবে না?

আসলে ছবির মতো সুন্দর নিউজিল্যান্ডে গিয়ে প্রজন্মের পর প্রজন্ম তো কম ছবি তোলেননি। খেলার মাঠে দিনের পর দিন পর্যুদস্ত হওয়ার পর সেলফি তুলেও ফেসবুকে কম ট্রল হননি ক্রিকেটাররা। নিউজিল্যান্ডের মাটিতে নিউজিল্যান্ডকে হারানোর স্বপ্নটা শুধুই স্বপ্ন থেকে গেছে তাদের কাছে। যদি ২০০১ সাল থেকে ধরা যায় তাহলে জাভেদ ওমর বেলিম, আল শাহরিয়ার রোকন, সানোয়ার হোসেন, আমিনুল ইসলাম বুলবুলরা কেবলই ইনিংস ব্যবধানের হারের স্বাদ নিয়ে এসেছেন। প্রথম ওই সফরটিতে হ্যামিলটন আর ওয়েলিংটনে দুটি টেস্টই ইনিংস ব্যবধানের লজ্জা নিয়ে ফিরেছিল দলটি। নিউজিল্যান্ডের ওই পিচে পাঁচ দিন খেলা টেনে নিয়ে যাওয়াটাই তাদের স্বপ্ন ছিল। এর মধ্যে কোনো হীনম্মন্যতা ছিল না, বরং স্টিফেন ফ্লেমিংয়ের ওই দলটির বিপক্ষে মাঠে নামতে পারার একটা চোরা গর্ব মিশে ছিল। খালেদ মাসুদ পাইলটদের ওই দলটির তখনকার বাস্তবতায় কিউইদের বিপক্ষে আড়াইশ করাটাও কম অর্জন ছিল না। এরপর যদি 'দ্বিতীয় প্রজন্মে'র কথা বলা যায়, তাহলে সেটা শুরু হয়েছিল ২০০৮ সালে হাবিবুল বাশার সুমন, মোহাম্মদ আশরাফুলদের সঙ্গে নবাগত তামিম, সাকিব, মুশফিকদের সংযোজন। দ্বিতীয় ওই প্রজন্মটি নিঃসন্দেহে এক ধাপ এগিয়ে গিয়েছিল। ওই সফরের দুটি টেস্টে তারা ইনিংস এবং ৯ উইকেটের ব্যবধানে হেরেছিল। এরপর ২০১০ সালে অনেকটা অভিজ্ঞতা নিয়েই নিউজিল্যান্ডে গিয়েছিল তারা। হ্যামিলটনে কিউইদের ৫৫৩ রানের জবাবে ৪০৮ রান করেছিল। মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ ১১৫ আর সাকিব খেলেছিলেন ৮৭ রানের ইনিংস। ওই টেস্টে নিউজিল্যান্ড ১২১ রানে জিতলেও টাইগারদের মধ্যে প্রবল একটি আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়েছিল। নিউজিল্যান্ডে 'আমরাও জিততে পারি'- এই বিশ্বাসটা বোধহয় ওই সফর থেকেই ভিত গড়েছিল।

দ্বিতীয় প্রজন্মের তৃতীয় সফরটি ছিল ২০১৭ সালে। ওয়েলিংটনে সেই স্মরণীয় টেস্ট। সাকিবের ২১৭ আর মুশফিকের ১৫৯ দিয়ে বাংলাদেশের ৫৯৫ রান। মাউন্ট মঙ্গানুইয়ে এই যে বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেটের 'শ্রেষ্ঠ জয়' সেটা বোধহয় শুরু হয়েছিল ওয়েলিংটনের ওই টেস্ট দিয়েই। একটা অভাব ওই প্রজন্মের দলটির মধ্যে প্রবলভাবে উপস্থিত ছিল। আর সেটা হলো প্রতিপক্ষের ২০ উইকেট শিকার করার মতো বোলার। ঘরের মাঠে স্পিনারদের দিয়ে, আরও সংক্ষেপে বললে সাকিব-মিরাজ আর তাইজুলকে দিয়ে ২০ উইকেট নেওয়ার রেসিপি তৈরি করা গেলেও পেসারদের নিয়ে সেই কীর্তি গড়াটা ছিল সত্যিই অবিশ্বাস্য একটি ব্যাপার।

অবশেষে এই তৃতীয় প্রজন্ম এসে সেই ঘাটতি বোধহয় পূরণ করতে যাচ্ছে। পেসার এবাদতের সঙ্গে শরিফুল আর তাসকিন- এই যেন নিউজিল্যান্ডের মাটিতে বাংলাদেশ ১০ টেস্টে এসে জয়ের দেখা পেল, সব ফরম্যাট মিলিয়ে ৩৩ ম্যাচে এসে বিজয়ী হলো তার অনন্য কৃতিত্ব কিন্তু এই পেসারদের। এটা অনস্বীকার্য যে, ক্রিকেটীয় দক্ষতা টাইগারদের সব প্রজন্মের মধ্যেই কম-বেশি ছিল, কিন্তু টেস্ট ক্রিকেটের যে ধ্রুপদি মেজাজ, যে ধৈর্যশীল মানসিকতা- তা বোধহয় তৃতীয় প্রজন্মের এ দলটিকেই সবার থেকে এগিয়ে দিয়েছে। নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে একটা বৃত্তপূরণের দিকে এগোতে হবে তাদের। টেস্টে এখনও ভারত, পাকিস্তান আর দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারাতে পারেনি বাংলাদেশ। হয়তো এই প্রজন্মই সেই অপূর্ণতাও ঢেকে দেবে।

মন্তব্য

আরও দেখুন

নতুন যুগ টিভি