শিক্ষার্থী পাচ্ছে না বাকিগুলো

২০ হাজার কিন্ডারগার্টেন বন্ধ হয়ে গেছে

সর্বমোট পঠিত : 81 বার
জুম ইন জুম আউট পরে পড়ুন প্রিন্ট

ঐক্য পরিষদের চেয়ারম্যান বলেন, সরকার যদি এই এক কোটি শিক্ষার্থীকে পাঠদান করাত, তাহলে তাদের জন্য নতুন নতুন অবকাঠামো তৈরি করতে হতো। শিক্ষক নিয়োগ ও তাদের ট্রেনিং বেতন-ভাতা বাবদ সরকারকে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করতে হতো। আমরা নিজেদের উদ্যোগে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিষ্ঠা করে শিক্ষাক্ষেত্রে বিশাল অবদান রাখছি। করোনাকালে সরকারের কাছে আর্থিক সহায়তা চেয়েছি। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, সরকার আমাদের কোনো সহায়তা করেনি। স্কুলগুলো টিকিয়ে রাখার জন্য সরকারের কাছে সহজ শর্তে ব্যাংকঋণ চেয়েও পাইনি।

'আশার আলো বিদ্যানিকেতন'- মিরপুরের রূপনগর থানার ইস্টার্ন হাউজিংয়ের এল-ব্লকের এই বিদ্যালয়টি গত বছরের মার্চেও শিক্ষার্থীদের পদচারণায় জমজমাট ছিল। শিক্ষক ছিলেন ১০ জন। ২০১৮ সালে এই কিন্ডারগার্টেন স্কুল চালু করেছিলেন মো. জাকির হোসেন। তিনিই ছিলেন প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক ও প্রধান শিক্ষক। করোনা মহামারির কারণে দেড় বছর বন্ধ থাকার পর গত ১২ সেপ্টেম্বর সরকার স্কুল-কলেজ খুলে দিলেও এ প্রতিষ্ঠানটি আর খোলেনি।

সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে বিদ্যালয়টির অস্তিত্বও খুঁজে পাওয়া যায়নি। বিপুল ভাড়া বকেয়া থাকায় বাড়িওয়ালা বাসাটি নতুন করে ভাড়া দিয়ে দিয়েছেন। নিভে গেছে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক জাকির হোসেনের সব আশার আলো। গত রোববার বিকেলে মোবাইল ফোনে সমকালের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, মহামারি করোনায় আর্থিক সংকটে পড়ে তিনি দুর্বিষহ জীবনযাপন করছিলেন। একপর্যায়ে বাধ্য হয়ে নিজের ভাড়া বাসাও ছেড়ে দিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন গ্রামের বাড়ি বরিশালের বানারীপাড়ায়। চিন্তা করছেন, জীবনধারণের জন্য নতুন করে কী করা যায়! জাকির হোসেনের আশার আলো বিদ্যানিকেতনের মতোই বন্ধ হয়ে গেছে সারাদেশের অন্তত ২০ হাজার কিন্ডারগার্টেন স্কুল। এসব স্কুলের সঙ্গে সম্পৃক্ত লক্ষাধিক শিক্ষক এখন বেকার।

কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোতে সাধারণভাবে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হয়। এখানে প্লে গ্রুপ থেকে চার বছর বা তার বেশি বয়সী শিক্ষার্থীদের ভর্তি করানো হয়। প্রথম শ্রেণিতে ওঠার আগে এসব শিক্ষার্থীকে নার্সারি ও কেজি নামে আরও দুটি ক্লাস পেরোতে হয়। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে আবার প্রি-ক্যাডেট এবং স্কুল অ্যান্ড কলেজ নাম যুক্ত করে অষ্টম শ্রেণি বা এসএসসি পর্যন্তও পড়ানো হয়। সরেজমিনে রাজধানীতে বন্ধ হয়ে যাওয়া বহু কিন্ডারগার্টেনের খোঁজ মিলেছে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, বন্ধ হয়ে গেছে রাজধানীর গুলশান এলাকার কালাচাঁদপুর পশ্চিমপাড়ার 'লন্ডন ইন্টারন্যাশনাল একাডেমি'। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক ও প্রধান শিক্ষক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, 'করোনার দেড় বছরে অনেক ক্ষতি হয়েছে। আর পারছিলাম না। শিক্ষার্থীরা চলে গেছে বিভিন্ন জায়গায়। স্কুল বন্ধ করে দিয়েছি। পুঁজি জোগাড় করতে পারলে দেখব, সামনের বছর কিছু করা যায় কিনা।'


তিনি জানান, তার এই প্রতিষ্ঠানে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হতো। চলতি বছরও (২০২১) এসএসসিতে ১৩ পরীক্ষার্থী রয়েছে। ২০০৯ সালে তিনি স্কুল দিয়েছিলেন। দুই শিফটে শিক্ষক ছিলেন প্রায় ২০ জন। করোনাকালে ক্রমাগত ভাড়া দিতে না পারায় গত জুন মাসের প্রথম দিন বাড়ি ছেড়ে দিয়েছেন। বাড়িওয়ালা জমিসহ ভবনটিও বিক্রি করে দিয়েছেন। ছাত্রছাত্রীরাও সব বিভিন্ন জায়গায় চলে গেছে। তাই স্কুলের এখন আর কোনো অস্তিত্ব নেই।


মোহাম্মদপুরের নবীনগর হাউজিং এলাকার ফুলকুঁড়ি কিন্ডারগার্টেন অ্যান্ড হাই স্কুল বিক্রির বিজ্ঞাপন দিয়ে গত বছর বেশ আলোচনায় এসেছিলেন প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা তকবির আহমেদ। তিনি জানান, বিদ্যালয় তিনি খুলেছেন বটে, তবে চালাতে পারছেন না। তাই খুলেও স্বস্তিতে নেই। ২৫০-এর বেশি শিক্ষার্থীর এ প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে ১০০ শিক্ষার্থীও এখন আর আসছে না। যোগাযোগ করে জানা গেছে, পরিবারের সঙ্গে গ্রামে চলে গেছে। কয়েকজন ছাত্রীর বিয়ে হয়ে গেছে। দরিদ্র পরিবারের ছাত্ররাও আর স্কুলমুখী হতে চাইছে না। তকবির আহমেদ প্রশ্ন করেন, কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলো একমাত্র টিউশন ফির ওপর নির্ভরশীল। ছাত্রছাত্রী না এলে স্কুল চালাব কী করে?


পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে রাজধানীর আদাবর এলাকার ৫ নম্বর বায়তুল আমান হাউজিংয়ের সামিট স্কুল অ্যান্ড কলেজও। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক হেলাল উদ্দিন এখন টিউশনি করে চলেন। পরিবার-পরিজন পাঠিয়ে দিয়েছেন মাগুরা জেলার মহম্মদপুরে গ্রামের বাড়িতে।


হেলাল উদ্দিন বলেন, প্রায় ৩৫০ জন ছাত্রছাত্রী ছিল করোনার আগে তার প্রতিষ্ঠানে। করোনা শুরু হলে অভিভাবকদের আয় কমে গেলে তারা টিউশন ফি দেওয়া বন্ধ করে দেয়। এতে বিপুল বাড়িভাড়া বকেয়া পড়ায় তিনি গত জুনের ২৫ তারিখে বাড়ি ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, তার প্রতিষ্ঠানের ১০ জন শিক্ষক ও তিনজন কর্মচারীর সবাই এখন বেকার। তারাও হতাশার সাগরে নিমজ্জিত।


একই ঘটনা ঘটেছে গাবতলী বাসস্ট্যান্ডের অদূরে অবস্থিত 'হোমল্যান্ড মডেল একাডেমি'তেও। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ১০ ওয়ার্ডের গৈদারটেক এলাকার এ স্কুলের প্রায় ২৫০ শিক্ষার্থীর কেউই আর বিদ্যালয়ে আসছে না। ২০১২ সালে এ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বীরেন চন্দ্র হালদার।
একই ব্যক্তির আরেকটি কিন্ডারগার্টেন স্কুল দারুস সালাম থানার ২২/২ আনন্দনগরের 'শতদল কিন্ডারগার্টেন'ও বন্ধ হয়ে গেছে। ২০০২ সালে চালু করা এ বিদ্যালয়েও দুই শতাধিক ছাত্রছাত্রী ছিল। বীরেন চন্দ্র হালদার বলেন, 'বাড়িভাড়া দিতে না পারায় স্কুল দুটি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছি। করোনায় অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু হয়ে গেছি। এত কষ্টে আছি যে তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।' রাজধানীর বাড্ডা এলাকার 'বাড্ডা শিশুনিকেতন'ও বন্ধ হয়ে গেছে।
প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক নার্গিস খান বলেন, এই মাসে সব প্রতিষ্ঠান খুললেও আমাদেরটা আর খুলতে পারিনি। ছাত্রছাত্রীরাও এদিক-সেদিক বিভিন্ন জায়গায় চলে গেছে। একই দশা ভাটারা এলাকার জোয়ার সাহারা পপুলার স্কুলে। এটিও বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা লক্ষ্মণ চন্দ্র। খিলক্ষেত এলাকার নিউ প্রত্যাশা স্কুলের পরিচালক মোহাম্মদ মফিজও তার বিদ্যালয় বন্ধ করে দিয়েছেন। এ নিয়ে তিনি কোনো কথা বলতেও রাজি নন গণমাধ্যমের সঙ্গে।

ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকার মাটিকাটায় অবস্থিত ইন্সপায়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজ গত ১২ সেপ্টেম্বর চালু হলেও অবস্থা খুবই খারাপ। স্কুলের পরিচালক নাজমুন নাহার রেখা বলেন, করোনার বন্ধের আগে তাদের ২৭০ জনের বেশি ছাত্রছাত্রী ছিল। এখন ১০০ জনেরও কম বিদ্যালয়ে আসছে। যারা আসছে, তারাও বেশির ভাগ দরিদ্র পরিবারের- স্কুল থেকে যাই যাই করছে। তারা বলছে, সব ফ্রি করে না দিলে পড়া সম্ভব নয়। প্রতিষ্ঠানের তিনজন শিক্ষক চাকরি ছেড়ে চলে গেছেন। এখন আছেন ১ ০ জন।
নাজমুন নাহার রেখা বলেন, নিজের বাড়ি হওয়ায় কোনোরকমে টিকে আছি। নইলে এত দিনে বন্ধ করে দিতে বাধ্য হতাম। এখন শিক্ষার্থী না পেলে স্কুল চালু রেখে লাভ কী?

বন্ধ হয়ে গেছে ঢাকার বাইরেরও হাজার হাজার স্কুল। চট্টগ্রামের আকবর শাহ থানার বিশ্ব কলোনি এলাকায় অবস্থিত ভিশন ইন্টারন্যাশনাল স্কুলও এখন বন্ধের তালিকায় নাম লিখিয়েছে। একই এলাকার গ্লোরি বার্ড স্কুলও বন্ধ হয়ে গেছে। দুটি স্কুলেরই প্রতিষ্ঠাতা আমজাদ হোসেন। 'কেন স্কুল বন্ধ করে দিলেন'- জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা দারিদ্র্যপ্রবণ এলাকা। বেশির ভাগ অভিভাবক পরিবার নিয়ে গ্রামে চলে গেছেন। অথচ এখানকার বাড়িভাড়া অনেক। পুঁজি জোগাড় করে স্কুল দুটি ফের চালুর চেষ্টা করছেন তিনি।

ঠিক কতটি কিন্ডারগার্টেন স্কুল সারাদেশে বন্ধ হয়ে গেছে, তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান সরকারের কাছে নেই। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন্স) মনীষ চাকমা বলেন, কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলো তাদের মতো করে চলে। আমাদের কাছে তাদের কোনো তথ্য নেই।

তবে বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ঐক্য পরিষদের চেয়ারম্যান এম ইকবাল বাহার চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশে মোট কিন্ডারগার্টেনের সংখ্যা ৬০ হাজার। এগুলোতে কর্মরত শিক্ষকের সংখ্যা ১০ লাখ। শিক্ষার্থীর সংখ্যা এক কোটি। এসব প্রতিষ্ঠানের ৯৯ শতাংশই ভাড়াবাড়িতে প্রতিষ্ঠিত। তারা খবর নিয়ে দেখেছেন, এই ৬০ হাজার কিন্ডারগার্টেন থেকে বাড়িভাড়া পরিশোধ করতে না পারায় বর্তমানে প্রায় ২০ হাজার বন্ধ হয়ে গেছে। সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা পেলে হয়তো আরও ১০ হাজারের মতো কিন্ডারগার্টেন আগামী জানুয়ারিতে খুলতে পারে। তবুও বাকি ১০ হাজার স্কুল চিরদিনের জন্য বন্ধই থাকবে।

ঐক্য পরিষদের চেয়ারম্যান বলেন, সরকার যদি এই এক কোটি শিক্ষার্থীকে পাঠদান করাত, তাহলে তাদের জন্য নতুন নতুন অবকাঠামো তৈরি করতে হতো। শিক্ষক নিয়োগ ও তাদের ট্রেনিং বেতন-ভাতা বাবদ সরকারকে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করতে হতো। আমরা নিজেদের উদ্যোগে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিষ্ঠা করে শিক্ষাক্ষেত্রে বিশাল অবদান রাখছি। করোনাকালে সরকারের কাছে আর্থিক সহায়তা চেয়েছি। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, সরকার আমাদের কোনো সহায়তা করেনি। স্কুলগুলো টিকিয়ে রাখার জন্য সরকারের কাছে সহজ শর্তে ব্যাংকঋণ চেয়েও পাইনি।

তিনি সরকারের কাছে অনুরোধ করেন, কোনোমতে এখনও টিকে থাকা ৪০ হাজার কিন্ডারগার্টেনকে টিকিয়ে রাখতে শিক্ষকদের জন্য আর্থিক সহায়তা ও আমাদের জন্য সহজ শর্তে ব্যাংক লোনের ব্যবস্থা করে দিলে আবারও আমরা শিক্ষাক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারব।

মন্তব্য

আরও দেখুন

নতুন যুগ টিভি