শিশুশ্রম আর নয়; শিশুর জীবন হোক স্বপ্নময়

শিশুশ্রম আর নয়; শিশুর জীবন হোক স্বপ্নময়

শিশুশ্রম আর নয়;
সর্বমোট পঠিত : 394 বার
জুম ইন জুম আউট পরে পড়ুন প্রিন্ট

দেরীতে হলেও বাংলাদেশ লেবার কোড শিশু শ্রমের বয়স নির্ধারন করেছে। ২০১১ সালে তিনটি সংস্থা বাংলাদেশ সরকার, চাকুরীদাতা এবং শ্রমিকদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটি ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমের একটি তালিকা প্রস্তুত করেছে যেখানে ৩৬ প্রকারের কাজের কথা উঠে এসেছে। যা শুধু তালিকা পর্যন্তই হয়ে বসে আছে বাস্তবে এর প্রয়োগ চোখে পড়ে না, কারন সরকারের শ্রম মন্ত্রণালয়ের অধীনে কলকারখানা এবং শিশু শ্রম পরিদর্শনের দায়িত্ব প্রাপ্তদের উক্ত তালিকা অনুযায়ী মনিটরিং করতে খুব একটা চোখে পড়ে না।


শিশুশ্রম শিশুর অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে দিতে পারে, স্বপ্নময় জীবনকে অস্কুরেই বিনষ্ট করে দিতে পারে, বিষয়টি আমাদের
অনেকেরই জানা থাকলেও তেমন কোন মাথা ব্যথা নেই! আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় শিশু অধিকার বিষয়টি অনেকের কাছে
তেমন কোন গুরুত্বই বহন করে না! বরং শিশুকে শ্রমে অন্তর্ভুক্ত করে অর্থ উপার্জন শিশু ও পরিবারের জন্য রীতিমত
মঙ্গলজনক হিসাবেই চিন্তা করা হয়! শিশুকে কর্মস্থলে পেঠে বাতাস ঢুকিয়ে হত্যা করা, গৃহকর্মীকে লোহার উত্তপ্ত দন্ডের
ছ্যাঁকা দিয়ে অমানবিক নির্যাতন করা, ৮ বছরের গৃহকর্মীকে ধর্ষণ পরবর্তী হত্যা, ইত্যাদি খবরের শিরোনাম ও আমাদের
গা-সহা হয়ে গেছে মনে হয়। এসব ঘটার পরে গণমাধ্যমে যা ফলাও করে প্রচার হয় সেটির কিছু চিত্র যেমন পুলিশ ধরে
নিয়ে যাচ্ছে অথবা কোর্টে হাজির করা হচ্ছে এসব আমরা দেখতে পাই, কিন্তু বিচারের শেষ ফল খুব সামান্যই আমাদের
দৃষ্টিগোচর হয়ে থাকে, কারণ শিশু শ্রমিকের চেয়ে শিশু শ্রমিক নিয়োগ কর্তাগণ অনেক শক্তিশালী। বর্তমান অবস্থা চলতে
থাকলে শিশু নির্যাতন ও শিশু শ্রম কমে যাবে বলে অন্তত আমার মনে হয় না। বরং বর্তমানে একদিকে করোনার অতিমারী,
মানুষের আয় কমে যাওয়া, স্কুল কলেজ বন্ধ রাখা আর শিশু শ্রম বৃদ্ধি হওয়া একইসুত্রে গাঁথা বলে অনেকে মনে করে
থাকেন।

এই তো সেদিন নারায়নগঞ্জের রুপগঞ্জের একটি জুস কারখানায় অগ্নিকান্ডে ভয়ংকর মৃত্যুর মিছিল দেখল বাংলাদেশ তথা
বিশ^বাসী, চোখের সামনে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা একের পর এক মানুষের কয়লারুপে বস্তাভর্তি লাশ ভবন থেকে বের
করে নিয়ে আসছিল। ৫২টি তাজা প্রাণ ছটফট করে আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ে ছাই হয়ে গেল। সবচেয়ে নির্মম
তথ্য হলো ঐ ৫২ জনের মধ্যে ১৬জনই ছিল শিশু, শুধু শিশু নয় ওরা মরার আগে শিশু শ্রমিক নামে একটি তকমা নিয়ে
গেছে। ভাবতে পারেন শুধু মানবিক কারন নয় দেশের দেশের আইন অনুযায়ীও ওদের ওখানে থাকার কথা ছিল না। তবু
ওদেরকে সেখানে থাকতে হয়েছিল বা থাকতে বাধ্য করা হয়েছিল, ওদের কচি প্রাণ গুলো দিতে হল কিসের জন্য? কার
অবহেলার জন্য? কে নেবে এর দায়ভার? সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতায় বাংলাদেশ শিশু শ্রম অনেকটা সহনীয় একটি
বিষয় হিসাবে অনেকে ধারনা পোষণ করে থাকেন। আবার বাস্তবতার কারনে অনেক পরিবার শিশু শ্রমের বিনিময়ে প্রাপ্ত
অর্থ দ্বারাই পরিচালিত হয়ে থাকে। এইসুযোগে বেশরিভাগ চাকুরীদাতা প্রতিষ্ঠান শিশুদেরকে শ্রমিক হিসাবে নিয়োগ দিতে
পছন্দ করে থাকেন, কারন, শিশুদেরকে কম মজুরী দিয়ে রাখতে পারেন, তাছাড়া তারা মনিবের বাধ্যও থাকে বটে।
এটা এক নির্মম সত্য যে, একজন শিশু ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে জড়িয়ে পড়লে তার উজ্জ্বল ভবিষ্যতে নেমে আসে এক কালো
অন্ধকার, তার পৃথিবীর গন্ডি হয়ে যায় ক্ষুদ্রতর, অনেকেই এটাকে ভাগ্য হিসাবেই মেনে নেয়। বিসিএস/এমআইসিএস
এর তথ্যমতে বাংলাদেশ ৬-১৪ বছরের শিশু শ্রমিকের হার ১২.৮% প্রাইমারী স্কুলে ভর্তিকৃত শিশুর মধ্য থেকে ৫ম শ্রেণী
পাশের হার মাত্র ৬০.২%, যদিও প্রথম শ্রেণীতে ভর্তির হার ৯৫.১% এবং আদিবাসী শিশুদের মধ্যে শিশু শ্রমিকের হার
১৭.৬%। স্থানীয় ভাবে কোন কোন এলাকায় এই হার আরও বেশী।

যদিও তৃতীয় বিশে^র অনেক দেশেই-বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন কৌশল একটি মডেল হিসেবে গণ্য হয়েছে।
কিন্তু আজকের শিশুরাই আগামী দিনগুলোতে এই উন্নয়ন কৌশলের চালিকা শক্তি হিসেবে বিবেচিত হবে। সেই শিশুর
প্রাণ যদি থাকে গাড়ীর চাকার নীচে, আগুনের লেলিহান শিখার সামনে, জাহাজ ভাঙ্গা কারখানার মৃত্যু ফাঁদে, ইট ভাটার
জ¦লন্ত অগ্নি শিকার উপরে, মাদক নেশার থাবার সামনে, ওয়েল্ডিং মেশিন চালনার মত নানা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার মধ্যে,
তাহলে সেই মডেল কতদিন টিকবে তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।

টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) ৮.৭ অনুযায়ী ২০২৫ সালের মধ্যে সকল রাষ্ট্র শিশুশ্রম শূণ্যে নামিয়ে আনতে কার্যকরী
উদ্যোগ গ্রহন করার কথা। সেই অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকার ২০২৫ সালের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ খাত থেকে শিশুশ্রম শূন্যে
নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। তাই বাংলাদেশ সরকার শিশুশ্রম বন্ধে বিভিন্ন প্রশংসনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছে
এর মধ্যে রয়েছে জাতীয় শিশুশ্রম নিরসন নীতি ২০১০ বাস্তবায়নের জন্য জাতীয় কর্মপরিকল্পনা ২০১২-১৬ প্রনয়ন, মানব
পাচার প্রতিরোধ ও প্রশমন আইন ২০১২, শিশু আইন ২০১৩ অনুমোদন, শ্রম আইন-২০১৬ জাতীয় শিক্ষা নীতি ২০১০
প্রনয়ন এছাড়া শিশুসহ নাগরিকদের মৌলিক অধিকার বিষয়টি আমাদের সংবিধানের বিভিন্ন ধারায় বর্ণিত আছে। কিন্তু
বাস্তবতা হচ্ছে এখনো আমাদের শিশুরা মারাত্মক ভাবে অবহেলিত, বিশেষ করে নির্যাতন, সহিংসতা এবং শোষণের
শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত।

দেরীতে হলেও বাংলাদেশ লেবার কোড শিশু শ্রমের বয়স নির্ধারন করেছে। ২০১১ সালে তিনটি সংস্থা বাংলাদেশ
সরকার, চাকুরীদাতা এবং শ্রমিকদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটি ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমের একটি তালিকা প্রস্তুত করেছে যেখানে ৩৬
প্রকারের কাজের কথা উঠে এসেছে। যা শুধু তালিকা পর্যন্তই হয়ে বসে আছে বাস্তবে এর প্রয়োগ চোখে পড়ে না, কারন
সরকারের শ্রম মন্ত্রণালয়ের অধীনে কলকারখানা এবং শিশু শ্রম পরিদর্শনের দায়িত্ব প্রাপ্তদের উক্ত তালিকা অনুযায়ী
মনিটরিং করতে খুব একটা চোখে পড়ে না।

শিশু শ্রম প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে যত উদ্যোগই নেওয়া হোক না কেন সেটা কখনই কার্যকরী হবে না
যদি না ৪টি প্রতিষ্টান যেমন-রাষ্ট্র, পরিবার, চাকুরীদাতা এবং শ্রমিক সংগঠনগুলো ‘‘শিশু শ্রম’’ বিষয়টিকে সামন
গুরুত্বসহকারে না নেয়।

শিশুর নিকট থেকে অতিরিক্ত আয়ের লোভ থেকে প্রত্যেক অভিভাবককে বিরত থাকতে হবে এতে হয়তবা সংসার চালাতে
কিছুটা কষ্ট হতে পারে । আমি মনে করি বৃহত্তর স্বার্থের জন্য ক্ষুদ্রতর স্বার্থ ত্যাগ করা উচিত, নইলে আমাদেরকে
নারায়নগঞ্জের মত হৃদয়ে রক্তক্ষরণের ঘটনা বার বার দেখার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

বাংলাদেশ জাতীয় শিশুশ্রম জরিপ ২০১৫ অনুসারে ১২ লক্ষ শিশু এই মুহুর্তে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত আছে।
আসুন আমরা ঝুঁকিপূর্ণ শিশু শ্রম প্রতিরোধে সকলে মিলে একটি কার্যকরী প্রতিরোধ গড়ে তুলি, মৃত্যু ফাঁদ থেকে আমাদের
কোমলমতি শিশুদের রক্ষা করি এবং সকল শিশুর জন্য একটি স্বপ্নময় পৃথিবী উপহার দেই ।
মুহাম্মদ জামাল উদ্দিন
উন্নয়ন কর্মী ও সংগঠক।

মন্তব্য

আরও দেখুন

নতুন যুগ টিভি